সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

উদ্বোধনের অপেক্ষায় মূল কাজ

পদ্মা সেতুর প্রাকপ্রস্তুতি শেষ, প্রধানমন্ত্রী ফিতা কাটবেন ১২ ডিসেম্বর

লাভলু মোল্লা, মুন্সীগঞ্জ ও রোকনুজ্জামান পারভেজ, শরীয়তপুর

উদ্বোধনের অপেক্ষায় মূল কাজ

পদ্মা পাড়ে স্থাপন করা হয়েছে বসুন্ধরা সিমেন্টের সাইলো -বাংলাদেশ প্রতিদিন

স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হচ্ছে শিগগিরই।  প্রকল্পের মূল কাজ ও নদী শাসনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ১২ ডিসেম্বর এ উদ্বোধন করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। তবে সেতু সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। ইতিমধ্যেই জাজিরা পয়েন্টে সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজা ও অন্যান্য ফ্যাসিলিটির নির্মাণকাজ শুরু করেছে সেতু বিভাগ। চার লেন মহাসড়ক ও দুই লেন সার্ভিস সড়কবিশিষ্ট মোট ছয় লেনের সাড়ে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণ চলছে। একই অবস্থা মাওয়া অংশেও। এ ঘাটের এক কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর উপরে সাত নম্বর পিলারের কাছেই শুরু হবে প্রথম পাইলিং। এ জন্য সব আয়োজন প্রায় শেষ করা হয়েছে। পদ্মার দুই পাড়ের এ কর্মযজ্ঞে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় খুশি স্থানীয়  জনগণ। বিশাল এ কর্মযজ্ঞে ব্যবহার হচ্ছে বসুন্ধরা সিমেন্ট। চীনা প্রকৌশলী লুচাংহু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির পক্ষ থেকে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পদ্মা সেতুর কাজে বসুন্ধরা সিমেন্টকে বেছে নেওয়া হয়েছে। সে হিসেবেই প্রকল্পের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। এ জন্য দুই পাড়ে ১৪টি সাইলো বসিয়ে বসুন্ধরা সিমেন্ট উৎপাদন করা হচ্ছে।

শরীয়তপুর অংশের সেতু নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল কাজের এক-চতুর্থাংশের কাজ শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেশের বৃহত্তম এ প্রকল্পের তদারকি করছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সময় অনুযায়ী ২০১৮ সালের মধ্যেই পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এ জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা-ই করবে সরকার। মূল সেতু নির্মাণকাজ শুরুর আগে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড নির্মাণ ও নদীর তীর সংরক্ষণের কাজে হাত দেয় সেতু বিভাগ। ইতিমধ্যেই প্রকল্পের অধীনে সংযোগ সড়ক ও টোলপ্লাজা নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এই অংশে ডিজিটাল টোলপ্লাজাসহ অত্যাধুনিক সুবিধা সম্বলিত চার লেন মহাসড়ক ও দুই লেন সার্ভিস রোডসহ মোট ছয় লেনের এই সড়কটির উচ্চতা হবে মূল ভূমি থেকে স্থানভেদে ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু। আর এই বৃহত্তর সড়ক নির্মাণের জন্য ১০ কোটি সিএফটি বালুর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬০ কোটি টাকা। আর দুই কিলোমিটার নদীর তীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৯৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ আর্মি ও সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধানে ইতিমধ্যে সংযোগ সড়কের ২৫ শতাংশ কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটি। সংযোগ সড়কটিতে পাঁচটি ব্রিজ, ১২টি বক্স কালভার্ট ও আটটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতুর কাজ করছে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি ও নদী শাসনের কাজ করছে সিনোহাইড্রো করপোরেশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চায়না মেজর ব্রিজে নিয়োজিত একঝাঁক চাইনিজ ও বাংলাদেশি প্রকৌশলী, পদ্মা সেতুর টেকনিক্যাল পরামর্শক বিশেষজ্ঞ প্যানেল অব এক্সপার্র্র্ট, দক্ষ দেশি-বিদেশি প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে যাচ্ছেন। একদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণ এলাকায় চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ, অপরদিকে চীনের ন্যানটং ওয়ার্কশপে তৈরি হচ্ছে সেতুর নির্মাণকাজে ব্যবহারের সরঞ্জামের একটি বড় অংশ। যা সমুদ্রপথে জাহাজযোগে দেশে এনে সরাসরি সেতুর কাজে ব্যবহার করা হবে। চীনের অত্যাধুনিক ও অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রেজার মেশিন, ক্রেনসহ নানা ধরনের ভারী যন্ত্রপাতির সাহয্যে কাজ করা হচ্ছে। ভুটান থেকে আনা হচ্ছে বিশাল আকারের পাথর। যেগুলো অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন মেশিনের সাহায্যে নির্মাণকাজে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হচ্ছে। মূল সেতুর ৮০ শতাংশ উপকরণ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানান, এ প্রকল্পের প্রায় ২৬ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। সেতুর দুই পাশের সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজের ৬০ শতাংশ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ এ বছরের পয়লা মার্চ শুরু করে অ্যাঙ্কর পাইল বসানোর কাজ। এরপর ২০ মার্চ প্রতিষ্ঠানটি শুরু করে পরীক্ষামূলক পাইল বসানোর কাজ এবং জুলাইয়ে শুরু করে মূল পাইলিংয়ের আদলে ওয়ার্ক অ্যাবেলিটি পাইলিংয়ের কাজ। এসব পরীক্ষামূলক পাইলে আড়াই হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন হাইড্রোলিক হ্যামার দিয়ে চাপ দিয়ে ধারণক্ষমতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তিনি জানান, সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এখন মূল পাইলিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের পদ্মাপাড়।

সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে মূল পাইলিং কাজ এবং শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে নদী শাসন কাজের উদ্বোধন করবেন। তিনি বলেন, এ ঘোষণার পর থেকেই পদ্মার দুই পার যেন প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষায় রয়েছেন। গতকাল পদ্মা নদীর মুন্সীগঞ্জ পাড়ের মাওয়া পয়েন্ট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পাইলিং সাজানোর পাশাপাশি পাইলগুলো পদ্মায় আনার আগের পিলারের আশপাশ ঘিরে নানা প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করার পরই শুরু হবে মূল পাইলিং। এই অংশে ছয়টি সাইলোতে উৎপাদন হচ্ছে বসুন্ধরা সিমেন্ট। শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, সেতু প্রকল্পে সিমেন্ট সরবরাহের জন্য পাড় ঘিরে তৈরি করা হয়েছে বসুন্ধরা সিমেন্টের আটটি সাইলো। দ্রুতগতিতে চলছে সংযোগ সড়ক, শেষের পথে ওয়ার্কশপ, ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকদের আবাসন, সংযোগ সড়কের পাশের সার্ভিস সড়ক তৈরি, ড্রেজিং ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ। এ ছাড়া ভারী ভারী নির্মাণ যন্ত্র দিয়ে চলছে পাথর ভাঙা, মাটি কাটা, মাটি ভরাট করা, রাস্তা সমান করার কাজ। বিশাল স্তূপাকারে রাখা হয়েছে ইট, বালি, বড় বড় পাথর। সব মিলিয়ে মুন্সীগঞ্জের পদ্মাপাড়ে চলছে উৎসবের আমেজ। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে, পরিকল্পিতভাবে এবং দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হয়েছে। সেখানে রয়েছে স্কুল, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মার্কেট শেড, ওয়াটার ট্যাংক, বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, পাকা রাস্তা, পাকা ড্রেন, সুয়ারেজ লাইন। জানা যায়, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সর্ববৃহৎ এই সেতুটি ৪২টি পিলারের ওপর নির্মিত হচ্ছে। দুই তলাবিশিষ্ট এ সেতুর উপর তলা দিয়ে যানবাহন এবং নিচতলা দিয়ে রেল চলাচল করবে। এর পাইলগুলোর ১২০ মিটার যা ৪০ তলা ভবনের সমান কাঠামো পানির নিচে রাখা হচ্ছে। ১৫০ মিটার পর পর এই পিলার বসানো হচ্ছে। এ ছাড়া দেড় কিলোমিটার করে উভয়পাড়ে তিন কিলোমিটার সংযোগ সেতুর জন্য আরও ২৪টি পিলার করা হবে। মোট ৬৬ পিলারের জন্য ৬৬ পয়েন্টে মাটি পরীক্ষার কাজ শেষ। মূল সেতুর ৪২টি পিলারের মধ্যে ডিজাইন করার সময় ১৩টি পয়েন্টে মাটি পরীক্ষা হয়েছে এবং পরে ২৯টি পয়েন্টে মাটি পরীক্ষা করা হয়। মূল সেতুর ৪০টি পিলারে ছয়টি করে ২৪০ এবং দুই পাড়ের দুটিতে ১২টি করে ২৪টি অর্থাৎ ২৬৪টি পাইল করা হবে। দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যৌথভাবে কাজ করছে আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে।

সর্বশেষ খবর