পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বিলুপ্ত বেহুলাডাঙ্গা, দহলা খাগড়াবাড়ি এবং দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত কোটভাজনী ছিটমহল থেকে ১০ পরিবারের ২৬ জন সর্বশেষ পাড়ি জমালেন ভারতে। গতকাল বিকালে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার চিলাহাটি সীমান্তের অস্থায়ী চেকপোস্টে ট্রাভেল পাস পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতের কোচবিহার জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আয়েশা রানী তাদের বরণ করেন। গত ২৬ নভেম্বর পরিবারের সবাইকে বিদায় জানালেও জমিজমা বিক্রির কারণে তারা যেতে পারেননি সেদিন। দাম কম এবং নানা জটিলতার কারণে তারা জমি বিক্রি করতে পারছিলেন না। এসব পরিবারের ১০ সদস্য ট্রাভেল পাস পেলেও বাজার মূল্যে জমি বিক্রি করতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রকৃত বাজার মূল্যে জমি কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। জেলা প্রশাসন ১০ জনের কাছ থেকে সাত একর জমি ৫২ লাখ ৫১ হাজার ৬০ টাকায় কিনে নেয়। গত রবিবার সন্ধ্যায় এসব জমির নিবন্ধন শেষে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জমির মূল্য নগদ প্রদান করেন। কোটভাজনী ছিটমহলের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ ছিলেন মহেশ চন্দ্র রায় (৯০)। চোখের জলে গতকাল সকালে তিনি পাড়ি জমালেন ভারতে। তাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন গ্রামের মানুষ। ছোট-বড় সবাই পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিয়ে তাকে বিদায় জানান। দুই মেয়েকে রেখে গেলেন তিনি। ২৬ নভেম্বর পরিবারের ৯ সদস্য চলে গেলেও জমি বিক্রি না হওয়ার কারণে ছেলে রতন কুমারসহ তিনি থেকে যান। এরপর বাংলাদেশ সরকারের কাছে তিন বিঘা জমি বিক্রি করে সাত লাখ ৯২ হাজার টাকা নগদ পান তিনি। যাওয়ার সময় তিনি বলেন, ‘যাবা মনায় না বাহে। এই দেশত অনেক কিছুই রাখে গেনু’। বোদা উপজেলার বিলুপ্ত বেহুলাডাঙ্গা ছিটমহলের দোমাসু রায় (৬০) চার একর জমির মূল্য বাবদ ২৯ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৪ টাকা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সরকার জমি না কিনিলে মোর যাওয়া হতো না। ছেলেমেয়েরা সবাই চলে গেছে।’ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেখা করত কণিকা রানী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবা-মার হাত ধরে চলে যেতে হলো তাকে। সন্তোষ কুমার রায়ের পরিবারের সাতজন চলে গেলেন। তারা পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রি। ওপারে গিয়েও তারা এই কাজ করতে চান। এ নিয়ে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন ছিটমহল থেকে ১০৩ পরিবার থেকে ভারতে গেলেন ৪৭৮ জন।
এর আগে ২২, ২৩, ২৪ ও ২৬ নভেম্বর চার দফায় ৯৩টি পরিবারের ৪৫২ জন ভারতে গেছেন। পঞ্চগড়ের ৩৬ ছিটমহল থেকে চার নবজাতকসহ ভারতে যাওয়ার অপশন দিয়েছিলেন ৪৯১ জন। এর মধ্যে তিনটি পরিবারের ১৩ জন ভারতে যাওয়ার অপশন দিলেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশেই রয়ে গেলেন। দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে অস্থায়ী ক্যাম্পের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম আযম ভারতীয় হাইকমিশনের সেকশন অফিসার শৈলেন্দু কিশোরের হাতে কাগজপত্র তুলে দেন। শুরু থেকেই বিলুপ্ত ছিটমহল থেকে নাগরিকদের ভারতে পাঠানোর দায়িত্বে ছিলেন এই কর্মকর্তা। বিদায় বেলার ঐতিহাসিক এই ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে রইলেন তিনি। প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, ‘বিদায় বেলার করুণ সব দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছি। এ অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করার মতো নয়। সরকার আমার মতো একজন কর্মকর্তাকে এ দায়িত্ব দিয়েছে বলে আমি কৃতজ্ঞ। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘জটিল এই বিষয়টি সমাধান করতে পেরে ভালো লাগছে। এর জন্য সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং গণমাধ্যম কর্মীদের ধন্যবাদ। যারা ভারতে গেলেন তাদের জীবন সুখময় ও শান্তিময় হোক এটাই প্রার্থনা করি।’