বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চৌরাসিয়ার বাঁশিতে সুরের নৈবেদ্য

মোস্তফা মতিহার

চৌরাসিয়ার বাঁশিতে সুরের নৈবেদ্য

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ভারতের বিদায়ী হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

সন্ধ্যা থেকে চৌরাসিয়ার জন্য সংগীতপিয়াসীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা। এরপর মঞ্চে আসেন উপমহাদেশের অন্যতম সেরা বাঁশিবাদক পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। বাঁশি হাতে নিয়ে সেই বাঁশিতে প্রবাহিত করেন সুরের ধারা। বাঁশরিয়ার সুরে শাস্ত্রীয় সংগীতের আয়োজনকে সফল করে তোলেন চৌরাসিয়া। সুরে সুরে, টানে টানে, দমে দমে সৃষ্টি করেন সুরের এক নৈবেদ্য। ঠোঁটের কোণে বাঁশি স্থাপন করে সুর আনেন হৃদয়ের গহিন থেকে। সুরের মহাসাগরে অবগাহন করান এ দেশের সংগীতানুরাগীদের। স্বর্গীয় সুরের আবেশে সুরের সুধা ঢেলে দেন সমগ্র স্টেডিয়ামে।

বয়সে প্রবীণ এই শিল্পীর বংশীবাদন উম্মুাদনা সৃষ্টি করে যাচ্ছিল ২৫ বছরের যুবক থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধের হৃদয়ের তন্ত্রীতে। বাঁশির মায়াজালে সব বয়সী শ্রোতাকে একই কাতারে নিয়ে আসেন এ বংশীবাদক। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত বাঁশিতে রাগ-রাগিণীর মায়াজাল সৃষ্টি করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই উচ্চাঙ্গ সংগীত আসরের ইতি টানেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তার সুরের টান শেষ হতেই পর্দা নামে শাস্ত্রীয় সংগীতের সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ আসরের। হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সব শিল্পীই সুরের জাদুতে বিমোহিত করেন আর্মি স্টেডিয়ামে আগত দর্শক-শ্রোতাদের। সন্ধ্যা ৭টায় অনিমেষ বিজয় চৌধুরীর পরিচালনায় সিলেটের দল গীতবিতানের ধামার পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমাপনী আয়োজন। দেশ রাগে ধামার ও রাগ ভূপালিতে চতুরঙ্গ পরিবেশন করেন সিলেটের এই শিল্পীরা। অনিমেষ বিজয় চৌধুরীর সঙ্গে সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন কুমকুম ভৌমিক, নূর-ই-আফরোজ, পরেশ চন্দ্র পাল, রুমা চন্দ, শাগুফতা হক, সুব্রত মিত্র ও সোনিয়া রায়। পাখওয়াজে ছিলেন আলমগীর পারভেজ। তানপুরায় অভিজিৎ কুণ্ডু। এরপর ভরতনাট্যমে মঞ্চ কাঁপান বিদুষী আলারমেল ভালি। রতি সুখসারী, উননুনীর ভিককিনান, মাততাভাদদুরা ও আভোগী রাগে নৃত্যের ঝড়ে সমগ্র স্টেডিয়ামের দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যান এই নৃত্যপটীয়সী। প্রধান অতিথি থেকে সমাপনী রাতের উদ্বোধন করেন ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদ। ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ সময় বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, বিনিয়োগ বোর্ডের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ এ সামাদ। অতিথি ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।

ফজলে হাসান আবেদ বলেন, এ উৎসবে আমরা চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে হারিয়েছি। এবারের উৎসবটি তাই তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে।

পঙ্কজ শরণ বলেন, দুই দেশের সংস্কৃতির ধারা এক। একে অবলম্বন করে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে দৃঢ় হবে আমাদের বন্ধন। সংস্কৃতির আশ্রয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সেই বন্ধন সারা বিশ্বে উদাহরণ হয়ে থাকবে।

সভাপতির বক্তব্যে শাস্ত্রীয় সংগীতের গুরুত্ব তুলে ধরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, সংগীত বা সুকুমারচর্চার বিকাশ ঘটলে মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যায়। ভারতে বা উপমহাদেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের যে সাধনা হয় তা মুসলমান ও হিন্দু সমাজের যৌথ অবদান। স্বাগত বক্তব্যে আবুল খায়ের বলেন, এ উৎসবের চতুর্থ দিন সোমবার ৫৬ হাজার মানুষের সমাগম ঘটেছে। এদের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থীও ছিলেন। তাদের ভিতরে ভালো গান প্রবেশ করলে দেশকে তারা আরও ভালোভাবে সাজাতে পারবে।

সমাপনী পর্বের পর বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম সেতারিয়া ওস্তাদ বিলায়েত খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ইরশাদ খান পরিবেশন করেন ‘সুরবাহার’। এরপর খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন সামিহান কশলকর। সামিহান কশলকরের খেয়ালের মূর্ছনার পর সেতারে সুরের মহিমা তুলে ধরেন বিলায়েত খাঁর পুত্র ওস্তাদ সুজাত খান। ইমদাদখানি ঘরানায় সেতারের সপ্তসুরে জাদুর ভুবনে উপনীত করেন আর্মি স্টেডিয়ামের সব সুরাসক্তকে। সুজাত খানের পর মঞ্চে আসেন আসরের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রশিদ খান। খেয়ালে রাগ-রাগিণীর সুধা ঢেলে দিয়ে সুরের এ মহাসমুদ্রে উত্তাল ঢেউ তোলেন পদ্মশ্রী সম্মাননায় ভূষিত এই শিল্পী।

প্রসঙ্গত, স্কয়ার টয়লেট্রিজের নিবেদনে ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ২৭ নভেম্বর রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে শুরু হয় পাঁচ রাতের এ উচ্চাঙ্গসংগীত আসর।

 

সর্বশেষ খবর