বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সরকারিতে অবহেলা প্রাইভেটে বাণিজ্য

সাঈদুর রহমান রিমন

সরকারিতে অবহেলা প্রাইভেটে বাণিজ্য

দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। অস্ত্রোপচারের পর পেটের ভিতর ছুরি বা গজ রেখেই সেলাই দেওয়া, বাঁ পায়ের পরিবর্তে সুস্থ ডান পা কেটে ফেলা, প্যাথলজি পুরুষ রোগীর গর্ভধারণ (!) চিহ্নিত করা আর ভুল চিকিৎসায় রোগীর জীবন বিপন্ন করে তোলা যেন নিয়ম হয়ে পড়েছে। দাঁত তোলার নামে শিক্ষানবিস ডাক্তাররা হাত পাকাচ্ছেন, অনেক হাসপাতালে ডাক্তারের পরিবর্তে ওয়ার্ড বয়রাই সর্বেসর্বা। জটিল কঠিন অপারেশন করতেও দ্বিধা করছেন না তারা। সুযোগসুবিধাহীন সরকারি হাসপাতালে একশ্রেণির ডাক্তার, নার্স, আয়া-কর্মচারীর চরম দুর্ব্যবহারের সামনে রোগীরা থাকছেন বড়ই অসহায়।

এদিকে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে উন্নত চিকিৎসা আর ভালো ব্যবহারের নামে চলছে ‘গলাকাটা বাণিজ্য’। স্বাস্থ্যসেবার নামে গজিয়ে ওঠা বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোয় রোগীদের থেকে মাত্রাতিরিক্ত ‘সেবা (!) ফি’ আদায়ের পাগলা ঘোড়া চলছে তো চলছেই। দিনে দিনে এমনকি প্রতি ঘণ্টার ব্যবধানেও পাল্টে যাচ্ছে বেড ভাড়া, ডাক্তারের ফি। সকালে যে ডাক্তার রোগী দেখছেন ৫০০ টাকা ফি নিয়ে, বিকালেই তিনি হয়ে উঠছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার- রোগীপ্রতি ফি নিচ্ছেন দেড় হাজার। পুরোপুরি নিজেদের খেয়ালখুশিমতো যখন যা খুশি ফি বাড়াচ্ছেন, বাড়াচ্ছেন অন্যান্য চিকিৎসা সেবামূল্যও।

চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নামে চলমান নৈরাজ্য ও নির্মমতা দেখার যেন কেউ নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের খবরদারি আর অধিদফতরের নিয়মনীতি, হুঁশিয়ারির কোনো কিছুতেই পরোয়া নেই গুটিকয় বেসরকারি হাসপাতালের। অভিজাত হাসপাতাল নামের ‘চিকিৎসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো’র মালিক কর্তৃপক্ষ অনেক বেশি প্রভাবশালী। নিজেদের হাসপাতাল-ক্লিনিককে আন্তর্জাতিকমানের দাবি করে তারা দেশীয় আইন-নীতিমালাকে পাত্তা দেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২-এর ৩ ধারায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। গলব্লাডার, পিত্তথলির পাথর ও সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারণ করা রয়েছে ৩ হাজার ৪০০ টাকা। অথচ প্রাইভেট হাসপাতাল এ অপারেশন করতে আদায় করছে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা। চিকিৎসাসেবার নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত নেওয়াটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এমন কিছু নিশ্চিত না করায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রোগীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয় প্রসঙ্গে বেসরকারি একটি হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘ঢাকার অভিজাত হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা খরচের তুলনায় সিঙ্গাপুর-ব্যাংককে চিকিৎসা ব্যয় ১০ গুণ বেশি।’ তিনি বলেন, ‘আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক বেশি হওয়ায় চিকিৎসা খরচে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। এ ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ ছাড় দিলে চিকিৎসা খরচ আরও কমবে।’ ভুক্তভোগী রোগী ও স্বজনরা এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করে জানিয়েছেন, বেসরকারি হাসপাতালে অস্বাভাবিক মূল্য হাতানোর নানা ফন্দিফিকির। একই রোগের পরীক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে একেক স্থানে একেক রকম ফি আদায় হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই রোগীর পকেট খালি করে চলেছেন। ঢাকার পাঁচ তারকা খ্যাত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা খরচ পৃথিবীর যে কোনো উন্নত দেশের চিকিৎসা ব্যয়ের চেয়ে মোটেও কম নয়। কিন্তু উন্নত বিশ্বের আদলে সেবা আর আচরণের ছিটেফোঁটাও নেই। হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভর্তি থেকে শুরু করে শয্যা পাওয়া, কেবিন ভাড়া, ডাক্তার-বিশেষজ্ঞ পরিদর্শন ফি, বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই চলে ‘গলাকাটা বাণিজ্য’। চিকিৎসাসংক্রান্ত সেবামূল্য নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিন্দুমাত্র ভূমিকা না থাকায় প্রতিনিয়ত হাজারো ভোগান্তি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন চিকিৎসাপ্রার্থীরা। এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগী ভর্তি ফি ও বেড ভাড়ার ক্ষেত্রেও আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে, সেখানে সরকারি বিধিবিধানের কোনো তোয়াক্কা নেই। রোগী ভর্তি করতে হলেই ওই ক্লিনিকের ক্যাশ-কাউন্টারে অগ্রিম টাকা জমা রাখতে হয়। স্পেশালাইজড হাসপাতালে কমপক্ষে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অগ্রিম জমা রাখার নিয়ম জারি রয়েছে। এসব হাসপাতালের বেড ও কেবিন ভাড়া শুনলেও অনেকে আঁতকে ওঠেন। বারিধারার একটি অভিজাত হাসপাতালে স্ট্যান্ডার্ড বেডের দৈনিক ভাড়া ২ হাজার ৫০০, সেমি-প্রাইভেট ৩ হাজার ৭৫০, সিঙ্গেল প্রাইভেট কেবিনের ভাড়া ৬ হাজার ৮০০ টাকা। ডিলাক্স কেবিনের দৈনিক ভাড়া ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করার নজির রয়েছে। ধানমন্ডি এলাকায় মিরপুর রোডসংলগ্ন আরেকটি হাসপাতালে সাধারণ ওয়ার্ডের বেড ভাড়াও ১ হাজার ৫০০ টাকা করে আদায় হয়ে থাকে। সাধারণ ওয়ার্ডে কোনো বেডের চারপাশে পর্দা টানাতে পারলেই সে বেডের দাম ৪-৫ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ৫ ফুট প্রস্থ আর ১০ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি জায়গার ভাড়া কোন যুক্তিতে প্রতিদিন ৮ হাজার টাকা হয় তা জানার কোনো উপায় নেই। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অতিরিক্ত বিল শোধের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন হাজারো রোগী। রোগীরা ভোক্তা হিসেবে ন্যায্য সেবা ও প্রকৃত মূল্য অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হলেও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, ক্যাব বা অন্য কোনো সংস্থা পাশে দাঁড়াচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। তারা আরও জানান, চিকিৎসার নামে নানা ছলেবলে কৌশলে রোগী ও তার স্বজনদের পকেট খালি করেও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ক্ষান্ত হয় না, উপরন্তু রোগীকে বন্দী রেখে বা মৃত রোগীর লাশ জিম্মি করেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। অভিজাত হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতেও এসব বর্বরতা চলে অহরহ। নির্মমতার এ অভিযোগ শুধু ভুক্তভোগী রোগী-স্বজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এখন তা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উঠে এসেছে। এ দেশের চিকিৎসা ব্যয়, রোগী হয়রানি ও দায়িত্বশীলদের চরম অবহেলা নিয়ে সভা-সেমিনারে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনাও হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একাধিক জরিপেও বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয় অতিরিক্ত ফি আদায়ের প্রসঙ্গ এসেছে।

হত্যা করেও নিরপরাধ : ভুল চিকিৎসায় একের পর এক রোগী হত্যার অসংখ্য অভিযোগ মাথায় নিয়েও বহাল তবিয়তে থাকছেন ডাক্তাররা। কি সরকারি কি বেসরকারি, সব হাসপাতালেই অভিন্ন অবস্থা বিদ্যমান। গত পাঁচ বছরে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অজ্ঞতা, অবহেলা ও দায়িত্বহীনতাসহ ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে তিন শতাধিক রোগীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনায় নিহতদের স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা উত্তেজিত হয়ে হাসপাতাল-ক্লিনিক ভাঙচুর করেছেন, ডাক্তার-কর্মচারীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে উল্টো ঘটনাও ঘটে। সেসব স্থানে ডাক্তার, নার্স, কর্মচারীরা জোট বেঁধে উল্টো নিহত রোগীর আত্মীয়স্বজনদের ওপরও হামলা চালিয়েছেন। মারধরে আহত হলে তাদের পুলিশে সোপর্দ করার মতো নির্মম ঘটনাও ঘটেছে। নিহতদের আত্মীয়স্বজনরা ‘ডাক্তারের ভুলে মৃত্যু’র অভিযোগ তুলে থানায় জিডি করাসহ স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন পাঠিয়েছেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই ‘তদন্ত রিপোর্টে’ অভিযুক্ত ডাক্তারদের ‘নির্দোষ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ফলে শত অভিযোগের পরও অভিযুক্ত চিকিৎসকরা সহজেই রেহাই পেয়ে যান। বিএমডিসির এক সূত্র জানায়, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা এখানে খুবই কঠিন। একজন ভুক্তভোগী সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে বিএমডিসি ওই চিকিৎসককে চিঠি দেবে। এরপর ১৫ দিনের মধ্যে তাকে জবাব দিতে বলা হবে। চিকিৎসকের লিখিত জবাব পাওয়ার পর উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে সাক্ষ্য-প্রমাণে অভিযুক্ত হলে কাউন্সিল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। ১৯৮০ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী কাউন্সিল একজন ডাক্তারকে তার কৃত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা সর্বোচ্চ ১ বছরের জেল দিতে পারবে। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য- গত এক বছরে এখানে অভিযোগ জমা হয়েছে ২০-২৫টি। এর মধ্যে অভিযোগকারীর সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা ছিল ৫-৬টি। অন্যগুলোর কোনো কোনোটিতে নাম-ঠিকানা ছিল না। কোনোটির ঠিকানায় লেখা ছিল ‘এলাকার জনগণ’। আমলে নেওয়া ৫-৬টি অভিযোগের কী অবস্থা- এ প্রশ্নে এই দফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, কোনো না কোনোভাবে ডাক্তার ও ভিকটিমের ঐকমত্য হয়ে যায় এবং দরখাস্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

ডাক্তারদের ভাষ্য : রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা প্রসঙ্গে সিনিয়র ডাক্তাররা বলেছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, নানাবিধ কারণেই সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সেক্টরে বিভিন্ন সাংগঠনিক দলাদলির ধকল পোহাতে হয় তাদের। বছরজুড়েই চলতে থাকে শাস্তিমূলক বদলি, পদোন্নতি আটকে কোণঠাসা করার নানা তৎপরতা। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি থেকে শুরু করে নানারকম সংকট লেগেই থাকে। অপারেশন থিয়েটারেও ভাগ করে কাজ করতে হয়। ডাক্তাররা অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, হাসপাতালের চাকরিতে যোগদানের পর থেকে ডাক্তারদের ভাগ্যে আর বিশ্রাম জোটে না। ছুটির ক্ষেত্রেও তাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভুগতে হয়। একজন ডাক্তারের ছুটির আবেদন ৩৪টি বিভাগের টেবিল ঘুরে তবেই অনুমোদন পায়। এতসব মানসিক চাপের মধ্যেও ডাক্তাররা সর্বোচ্চ ধৈর্য নিয়ে রোগীদের সমস্যা শোনেন, দেখে সমাধান দিয়ে থাকেন।

সর্বশেষ খবর