শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কম বয়সী মায়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কেউ সতর্ক নয়

বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে জরিপ

জিন্নাতুন নূর

গাইবান্ধার এক বালিকাবধূ শিল্পী। ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় পলাশবাড়ীর মাঠেরহাটে। বিয়ের পর একে একে শিল্পী তিন মেয়ের জন্ম দেয়। অল্প বয়সে সন্তান প্রসব করায় তার নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। এখন প্রায়ই তার মাথা ঘোরে। অপুষ্টিতে ভুগছে। হাত-পা ঝিমঝিম করে। ভারী কাজ করতে কষ্ট হয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে শিল্পী জানায়, ‘বাড়িতে স্বাস্থ্যকর্মী আপারা এলেও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়টি পছন্দ করেন না। কাজ ছেড়ে কেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে   যাচ্ছে এ ধরনের কথাও শুনতে হয় শিল্পীকে। এমনকি গর্ভাবস্থায় বিশ্রাম নেওয়ার কারণে তাকে তার শাশুড়ি কেন কাজ করছে না এ কথা জানতে চেয়ে ঝাড়িও দিয়েছেন। বাল্যবিয়ের শিকার গাইবান্ধার আরেক গৃহবধূ ফাহিমা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৩ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। আমার দুই ছেলে। পছন্দের ছেলে পাওয়ায় মা-বাবা বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু সন্তান প্রসবের পর থেকে ফাহিমার অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। ফাহিমা প্রায়ই শরীরে দুর্বলতা অনুভব করেন। হাতে-পায়ে ব্যথা লেগেই থাকে। এ ছাড়া চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি যখন গর্ভবতী হই প্রথমে বুঝতি পারি নাই। সে সময় শরীর খুব দুর্বল হয়ে যায়। এমনকি বাচ্চা হওয়ার পরেও অসুস্থ লাগত।’ বাচ্চা সামলাতে না পেরে প্রায়ই অল্পতে রেগে যেতেন ফাহিমা। একই এলাকার আরেক গৃহবধূ শ্যামলী বলেন, ১১ বছর বয়সেই তার মা-বাবা বিয়ে দিয়ে দেন। এখন তিনি দুই কন্যাসন্তানের মা। বড়টির বয়স ৭ বছর আর ছোটটির সাড়ে ৪। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই প্রথম সন্তানের জন্ম হয় আর দ্বিতীয় সন্তান এর আড়াই বছর পর। ‘আগে বুঝি নাই এখন বুঝি অল্প বয়সে বিয়ার ঝামেলা অনেক। অন্য বাড়ির লোকজন খারাপ কথা কইব এই ভয়ে মা-বাপ ঝামেলা কমাইতে অল্প বয়সেই বিয়া দেয়। কিন্তু বিয়ার পর বুঝতে পারি যে, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে খুব একটা পছন্দ করত না। এ কারণে বাচ্চা হওয়ার আগেই আমার স্বামী আমার স্বাস্থ্যের কথা ভাইবা আমারে বাপের বাড়ি পাঠায় দেন’, বলেন শ্যামলী। বাংলাদেশের তিনটি জেলা গাইবান্ধা, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের ৯০০ কিশোরীর ওপর ইনিশিয়েটিভ ফর ম্যারেজ অ্যাডলোসেন্ট গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট (ইমেজ) একটি জরিপ চালায়। বিবাহিত কিশোরীদের ক্ষমতায়নের উদ্যোগ প্রকল্পের এ বেজলাইন জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ৯৮.৭ শতাংশ বিবাহিত কিশোরী মনে করে যে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বিয়ের সঠিক বয়স সম্পর্কে বেশির ভাগ বিবাহিত কিশোরীর সঠিক জ্ঞান থাকলেও জরিপ এলাকায় বাল্যবিয়ের চর্চা অনেক বেশি। এর কারণ এসব এলাকায় বাল্যবিয়ে সামাজিক প্রথা হিসেবে বহুকাল ধরে প্রচলিত। জরিপে জানা যায়, ৯১.৩ শতাংশ কিশোরীর ক্ষেত্রে তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মা-বাবা। আর জরিপে অন্তর্ভুক্ত কিশোরীদের গড় বয়স ছিল ১৪.৪ বছর। এ কিশোরীরা জানান, ৭৬ শতাংশই গর্ভকালে দুর্বল ও অসুস্থ বোধ করেছিলেন। ৪৬ শতাংশ অপুষ্টিতে ভোগেন। ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। ২৫ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়ের শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। ২২ শতাংশের গর্ভজনিত জটিলতা বেড়ে যায়। ১৯ শতাংশ মা রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। ১২ শতাংশ মায়ের সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় শারীরিক অন্য সমস্যা সৃষ্টি হয়। অথচ জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে অভিভাবকদের ধারণা, মাসিক শুরু হলেই মেয়েটি সন্তান জন্ম দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। জানা যায়, অল্প বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অংশ ২৮.৯ শতাংশই শুধু ফার্মেসিতে গিয়ে স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে চায়। এর মধ্যে ৮.৯ ও ৮.১ শতাংশ হাতুড়ে ও কবিরাজি চিকিৎসা নেয়। ৬.৭ শতাংশ আবার চিকিৎসার জন্য কোথাও যায়নি। জরিপের তথ্যমতে, কিশোরীরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগলেও তা বুঝতে পারে না। এমনকি এ সম্পর্কে তারা আলোচনা করতেও লজ্জা পায়। এদের মধ্যে ১৮.১ শতাংশ জানে না গর্ভকালে কতবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত। এমনকি বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয় (প্রায় ছয় মাস) ৪১ শতাংশ কিশোরী। এ প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বাল্যবিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রধান অন্তরায়। আমাদের এ-সংক্রান্ত একটি ভালো আইন থাকলেও দেশে ৬৪ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছর হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে যায়। ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বিয়ের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে বাল্যবিয়ের কারণগুলো চিহ্নিত করে সরকার ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে বাল্যবিয়ের প্রবণতা আগের চেয়ে কমেছে। শতভাগ সফল হওয়ার জন্য মন্ত্রী বিভিন্ন এনজিও ও গণমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করেন। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার সারা বিশ্বে চতুর্থ। ইউনিসেফের মতে, ২০০৫ থেকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে শতকরা ২৯ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই। আর শতকরা ৬৫ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ের পর তাদের লেখাপড়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তারা খুব দ্রুত গর্ভধারণ করে, তাদের অধিকাংশেরই পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে তেমন ধারণা থাকে না। কিছু ক্ষেত্রে স্বামীপরিত্যক্তা কিশোরী তাদের শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ দেশে বেশ কিছু অভিভাবক মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে ১৫-১৬ বছরকে সঠিক বলেই মনে করেন। আমাদের এ-সংশ্লিষ্ট আইনও আছে। তার পরও বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। বাল্যবিয়েকে তিনি সুস্পষ্টভাবে মেয়েশিশুর জন্য মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মনে করেন; যা পরে মাতৃমৃত্যু হারের সংখ্যা বাড়ায়। তার মতে, সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগে দুর্বলতা ও সচেতনতার অভাবে বাল্যবিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর