শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

হাসপাতালেও রেহাই নেই নারীদের

যৌন হয়রানি

জিন্নাতুন নূর

হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে এসেও অসহায় নারী রোগীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। রাস্তাঘাট, কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর যৌন হয়রানির কথা শোনা গেলেও এখন হাসপাতালও বাদ যাচ্ছে না। চিকিৎসা নিতে গিয়ে তারা নানাভাবে নিপীড়কদের বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছেন।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নারীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, কোনো কোনো চিকিৎসক থেকে শুরু করে হাসপাতালের ব্রাদার (পুরুষ নার্স) ও অন্য কর্মচারীরা তাদের ওপর যৌন নির‌্যাতন করছেন। বিকৃত রুচির এ মানুষগুলো রোগীকে শুধু অশালীন প্রস্তাব দিয়েই থামছেন না, নানাভাবে যৌন নির‌্যাতন করে তা চেপে যাওয়ার জন্য হুমকিও দিচ্ছেন। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে যৌন হয়রানির শিকার নারী রোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ঘটনা ঘটার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিছু ক্ষেত্রে মানসম্মানের ভয়েও ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবার যৌন হয়রানির বিষয়টি চেপে যান।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাবার সেবা করতে এসে এক তরুণী গত ২২ মে কর্তব্যরত এক আনসার সদস্যের দ্বারা যৌন নির‌্যাতনের শিকার হন। এ বিষয়ে তিনি নিজে বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। কিন্তু ঘটনার পরপরই অভিযুক্ত আনসার সদস্য পালিয়ে যান। এ ছাড়া নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলতি বছরের এপ্রিলে এক নারী চিকিৎসা করাতে এসে হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট রেজাউল কর্তৃক অশালীন প্রস্তাব পান। এই রোগী জানান, তার পরিচিত অন্য নারীরাও এ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসে এভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। একইভাবে চলতি বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে শিক্ষানবিস হেলথ টেকনোলজিস্টের যৌন লালসার শিকার হন আরেক নারী। এ ব্যাপারে সেই ভুক্তভোগী নারী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিত নোটিস দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের তিন সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তে এ অভিযোগের সত্যতাও মেলে। এ ছাড়া চলতি বছরের অক্টোবরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) চিকিৎসা নিতে এসে চিকিৎসকের মাধ্যমে এক নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। হাসপাতালের চর্ম বিভাগের এক চিকিৎসক এ ঘটনা ঘটান। এ ব্যাপারে সেই নারী হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। রামেকের পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা এর সত্যতা নিশ্চিত করেন। সর্বশেষ রাজধানীর গুলশানের অভিজাত ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিসিইউতে ১ ডিসেম্বর এক নারী রোগী যৌন হয়রানির শিকার হন। সেই নারী অভিযোগ করেন, হাসপাতালের এক ব্রাদার অপারেশনের পর অচেতন অবস্থায় তার সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। এ সময় তার জ্ঞান ফিরে এলে বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি তার ছেলের মাধ্যমে অন্য নার্সদের ডেকে বিষয়টি খুলে বলেন। কিন্তু এ ঘটনার পর সেই নার্সেরা অভিযুক্ত ব্রাদারকে সরিয়ে ফেলেন এবং ভুক্তভোগীকেও বিষয়টি তার স্বামীকে না বলার জন্য অনুরোধ করেন। ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অভিযুক্ত ব্রাদারকে বরখাস্ত এবং পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই সঙ্গে পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপ না হয় তার জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেমন- অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নারী রোগীদের বিভাগে শুধু সিস্টার বা নারী সেবিকাদের দায়িত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া হাসপাতালে সিসি টিভি ক্যামেরার ব্যবহার বৃদ্ধির ওপরও জোর দিতে হবে। এর ফলে কেউ কোনো অশালীন কাজ করলে তা রেকর্ড হবে এবং পরে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার সময় তা কাজে আসবে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ঘটনার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাসপাতালের নিবিড় পরিচর‌্যা কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক নার্স ও দায়িত্বরত চিকিৎসকের থাকার কথা। কিন্তু ইউনাইটেড হাসপাতালে তা ছিল না বলেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য হাসপাতালের সার্বক্ষণিক নজরদারি বৃদ্ধির ওপর তিনি জোর দেন। কারণ একজন রোগী অসুস্থ থাকায় তিনি স্বাভাবিকভাবেই নার্সদের সহায়তার ওপর নির্ভর করবেন। এ অবস্থায় তার পাশে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের থাকতে হবে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, ইউনাইটেডের মতো হাসপাতালে যেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটে, সেখানে দেশের বাকি হাসপাতালগুলো নারীদের জন্য কতটা অনিরাপদ, তা চিন্তা করা যায় না! এ ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে তা হলো, যে নারীরা হাসপাতালে যৌন নির‌্যাতনের শিকার হবেন তাদের বিষয়টি চেপে না গিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। তা না হলে এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

সর্বশেষ খবর