শিরোনাম
শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকারে বগুড়া শিয়া মসজিদের ইমাম শাহিনুর

রুকুতে যেতেই শুরু হয়ে গেল একের পর এক গুলি

আলী আজম

রুকুতে যেতেই শুরু হয়ে গেল একের পর এক গুলি

এশার নামাজ শেষ করে মুস্তাহাব নামাজ পড়ছিলাম। প্রথম রাকাত শেষ করে দ্বিতীয় রাকাত নামাজে দাঁড়িয়েছি। রুকুতে যেতেই শুরু হয়ে গেল একের পর এক গুলি। আমার কোমরের ডান পাশে গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। চোখে ঝাপসা দেখছিলাম। এই বুঝি প্রাণ যায়। দাঁড়ানোর শক্তি না পেয়ে পড়ে গেলাম। কোমরে হাত দিতেই দেখি ছোপ ছোপ রক্ত। বুঝতে পারলাম দুর্বৃত্তরা হামলা করছে। আÍরক্ষার্থে মেহরাবের কাছে যেতেই অচেতন হয়ে পড়ি।

গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসব কথা বলছিলেন গুলিতে আহত বগুড়ার শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদুল মোস্তফা মসজিদের ইমাম মো. শাহিনুর রহমান। তিনি বলেন, গুলির শব্দ থামতেই আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। পেছনে তাকাতেই দেখি মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জিম হোসেনের মাথা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আরও দুই মুসলি­ (আফতাব আলী ও তাহের মিস্ত্রি) গুলিবিদ্ধ হয়ে ছটফট করছেন। অন্য মুসলি­রা ধর ধর বলে হামলাকারীদের পেছনে ছুটছেন। দুর্বৃত্তরা দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়। এরপর মুসলি­রা আমাদের উদ্ধার করেন। পরে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে ও মুয়াজ্জিনকে পাশাপাশি রাখা হয়। তখন চিকিৎসকরা বলেন, দুজনকে একসঙ্গে রাখা যাবে না। কিছুক্ষণ পরই কর্তব্যরত চিকিৎসক মুয়াজ্জিনকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর খবর শুনতেই মনে হচ্ছিল আমি বুঝি আর বাঁচব না। শঙ্কা কেটে গেলেও ওই দিনের কথা মনে হতেই নিজের অজান্তে চোখের কোণে পানি চলে আসে। এখনো কোমরে চিন চিন করে ব্যথা হচ্ছে। সোজা হয়ে বসতে পারছেন না। গুলি বের করা হলে তার একটি পা অচল হয়ে যেতে পারে। শাহিনুর রহমান বলেন, ঘটনার সময় মসজিদে ২০-২২ জন মুসলি­ ছিলেন। তার পেছনেই মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জিম হোসেন নামাজ আদায় করছিলেন। দুর্বৃত্তদের একটি গুলি মুয়াজ্জিনের মাথায় বিদ্ধ হলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অপর একটি গুলি তার কোমরে বিদ্ধ হয়। দুর্বৃত্তরা হত্যা করতেই এসেছিল। রুকু থেকে পড়ে যাওয়ায় দুর্বৃত্তরা হয়তো মনে করেছিল আমি মারা গেছি। এরপরই তারা চলে যায়। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বীভৎসতা ভুলতে পারছি না। শাহিনুর রহমান মুসলি­ ও স্থানীয়দের বরাত দিয়ে বলেন, দুর্বৃত্তরা সংখ্যায় তিনজন ছিল। তাদের বয়স ২৫-৩০ বছর। তাদের মধ্যে একজন পাজামা-পাঞ্জাবি এবং অন্য দুজন শার্ট-প্যান্ট পরিহিত ছিল। তাদের পোশাক ছিল কালো। তারা মসজিদে হামলা করার আগে মসজিদের বাউন্ডারির লোহার গেটে নিজস্ব তালা ঝুলিয়ে দেয়। এরপর মসজিদের দরজায় এসে তাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। মাজহাব সংক্রান্ত বিরোধে দুর্বৃত্তরা তাদের ওপর হামলা করতে পারে বলে ধারণা করছেন শাহিনুর রহমান। জানা গেছে, শাহিনুরের স্ত্রীর নাম শাহনাজ আরেফিন (শ্যামলি)। ওই দম্পতির জয়নাল আবেদিন সাজ্জাদ (৮), আলী রেজা (৫) ও এক মাস বয়সী জাহারা বাতুল নামে তিন সন্তান রয়েছে। শাহিনুর এইচএসসি পাস করার পর হোমিও চিকিৎসায় ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। পরে আরবি ও ফারসিতে ডিপ্লোমা করেন। ২০০২ সালে বিয়ে করার পর ২০০৩ সালে তিনি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর বাসস্ট্যান্ডে শিয়া সম্প্রদায়ের ‘মসজিদুল মোস্তফা মসজিদ’-এর ইমাম হিসেবে যোগ দেন। এ ছাড়া তিনি চলতি বছরের শুরুতে হরিপুর বাসস্ট্যান্ডে ‘ফাতেমা হোমিও হল’ নামে একটি হোমিও ক্লিনিক গড়ে তোলেন। হোমিও ক্লিনিকে চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি মসজিদে ইমামতি করতেন। তার বাড়ি আটমন ইউনিয়নের চককানু গ্রামে। তার বাবা মজিবুর রহমান ও মা তহুফা বেগম আগেই মারা গেছেন। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে শাহিনুর ছোট। গত ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর বাসস্ট্যান্ডে শিয়া সম্প্রদায়ের এই মসজিদে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। পরে তাদের শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে মারা যান মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জিম হোসেন।

এ ঘটনায় মসজিদের ইমাম শাহিনুর রহমানসহ আফতাব আলী ও তাহের মিস্ত্রি নামে দুই মুসলি­ গুলিবিদ্ধ হন। ১ ডিসেম্বর বিকালে শাহিনুরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বগুড়া থেকে ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়। বর্তমানে তিনি হাসপাতালের ৪৯ নম্বর কেবিনে চিকিৎসাধীন। ঢামেক হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. এ টি এম আসাদুজ্জামান বলেন, শাহিনুরের শরীর থেকে গুলি বের করার প্রয়োজন নাও হতে পারে। সমস্যা হলে অস্ত্রোপচার করে তা বের করা হবে। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। পর‌্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তিনি শঙ্কামুক্ত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর