দুঃসহ যানজটে ক্রমেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে রাজধানী। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সড়ক, মোড়, ট্রাফিক ক্রসিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা মানুষ সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছে। কয়েকটি প্রধান সড়ক এবং গলিপথে মাসের পর মাস ধরে চলছে উন্নয়নের নামে ধারাবাহিক খোঁড়াখুঁড়ি। যেখানে সেখানে পড়ে থাকছে নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ। ভাঙাচোরা, খানাখন্দে পূর্ণ রাস্তার একাংশ বেদখল, অর্ধেক রাস্তাজুড়ে থাকছে শত শত গাড়ির এলোপাতাড়ি পার্কিং। মাঝরাস্তায় বাস-মিনিবাস থামিয়েই চলে যাত্রী ওঠানো-নামানো। আছে পদে পদে জঞ্জাল আর সীমাহীন বিশৃঙ্খলা। রাজনৈতিক কর্মী ও ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্যে দীর্ঘায়িত হচ্ছে যানজট।
সরেজমিন ঘুরে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে সীমাহীন অব্যবস্থাপনা, যানবাহন চালকদের আইন ভঙ্গ, ট্রাফিকের হয়রানি ও চালকদের স্বেচ্ছাচারিতা চোখে পড়ে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কের সিগন্যাল ও ক্রসিংয়ে দিনের বেশির ভাগ সময়ই যানজট লেগে থাকে। কোথাও রয়েছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ভোগান্তি। ক্রসিং ও ব্যস্ততম মোড়গুলোর মাঝামাঝি থামছে বাস-মিনিবাস, চলছে যাত্রী ওঠানো-নামানো। সেসব স্থানেই ঠায় দাঁড়ানো থাকে শত শত রিকশা। ফলে যানজটের বেহাল পরিস্থিতিতে স্থবির হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। প্রধান প্রধান সড়কজুড়েই ভয়াবহ যানজট, তা মুহূর্তে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে অলিগলি-মহল্লাতেও। নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াতে পুরোটা দিন লেগে যায়। কে কতক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাস্তবে রাস্তার তুলনায় গাড়ি বেশি এবং গাড়ির তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হওয়ায় নগরীতে যানজট সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন গাড়ি নামছে, কিন্তু রাস্তা বাড়ছে না মোটেও। উপরন্তু বিদ্যমান সড়কের অবৈধ দখলসহ যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। এসব কারণে যানজট নিরসনে বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজনও সুফল বয়ে আনতে পারছে না। ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে সাতরাস্তা থেকে মগবাজার হয়ে মৌচাক পর্যন্ত এবং মগবাজার থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত সীমাহীন বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে দুই বছর ধরেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ, যখন তখন রাস্তা বন্ধ করা, খুলে দেওয়ার বিদঘুটে কার্যক্রম চলছে। সাতরাস্তা-মগবাজারের ধকল মুহূর্তেই নগরীর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। হাতিরঝিল থেকে গাড়ির সে াত বেরিয়ে বাড্ডামুখী রাস্তায় নামতেই রামপুরা ব্রিজ থেকে শাহজাদপুর পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার রোড সীমাহীন যানজটে আটকে যায়। সব মিলিয়ে যানজটের ভয়াবহতায় রীতিমতো নাগরিক দুর্যোগের সৃষ্টি করেছে। যানজটে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি গুলশান-বনানী-বাড্ডা এলাকায়। সেখানে প্রতিটি রাস্তা, অলিগলিও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে স্থবির থাকছে। পুরান ঢাকার প্রধান সড়ক নর্থ-সাউথ রোডের অর্ধেকটা অনেক আগেই দখল করে নিয়েছে সংলগ্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। সিদ্দিকবাজার থেকে ইংলিশ রোডের মোড় পর্যন্ত সড়কে রড-সিমেন্ট, আসবাবপত্রের দোকানের মালামাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে দেখা যায়। কাকরাইল মোড়-শান্তিনগর-মালিবাগ পর্যন্ত সড়কে তিন সারিতে গাড়ি রাখতে দেখা যায়। তার পরও শত শত রিকশা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মালিবাগ মোড় থেকে মৌচাক হয়ে মগবাজার মোড় পর্যন্ত সড়কেও অভিন্ন অবস্থা। নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত এলাকার ফুটপাথ আর ফুটওভার ব্রিজজুড়ে রয়েছে হকারদের আধিপত্য। যানজট আর অবৈধ দখলবাজির কারণে বঙ্গবাজারের সামনে থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ফুলবাড়িয়ার রাস্তাটি চেনাই কষ্টকর। স্থানটি মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, কাপাসিয়া, কালিগঞ্জ, সাভার-ধামরাইসহ ৩০টি রুটের শত শত বাস-মিনিবাসের স্থায়ী পার্কিংস্থলে পরিণত হয়েছে। গুলিস্তানের সব ফুটপাথ-রাস্তাই হকারদের দখলে থাকে। সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী এলাকায়ও রয়েছে বহুমুখী সমস্যা। বিভিন্ন রুটের বাস সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ে ঠিক রাস্তার ওপরই দাঁড়ায়। সায়েদাবাদ থেকে যাত্রাবাড়ী যাওয়ার পথে ধলপুর ব্রিজটির কারণেও যানজট লাগে। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলীগামী বাসগুলোও এখানে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে এখানকার যানজট কমছে না। নগরের ভিতরে বেশ কয়েকটি রেল ক্রসিং যানজটের অন্যতম কারণ। এর মধ্যে খিলগাঁও, মালিবাগ, সোনারগাঁও ক্রসিংয়ের চরম অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ে।
৩৭ পয়েন্টে ২৯ কারণে যানজট : মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের তথ্যমতে, রাজধানীর ৩৭টি পয়েন্টে ২৯ কারণে যানজট লেগে থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে— রাস্তার স্বল্পতা, সমন্বয়হীন রুট পারমিট প্রদান, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল, মাত্রাতিরিক্ত রিকশা, সড়কের অপ্রশস্ততা, বেপরোয়া বিআরটিসি বাস, যত্রতত্র ট্রাকস্ট্যান্ড, রেলগেট, রাস্তায় জলাবদ্ধতা, খোঁড়াখুঁড়ি, মিছিল-মিটিং, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে অপরিকল্পিত পার্কিং, ফুটওভার ব্রিজের অভাব, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে পথচারীদের অনীহা, রাস্তায় আবর্জনার কনটেইনার, পার্কিংবিহীন বহুতল ভবন ইত্যাদি। জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী, কুড়িল, রামপুরা, মিরপুর টেকনিক্যাল, মগবাজার, উত্তরা, পল্লবী, মিরপুরসহ নগরীর ২১টি পয়েন্টে একযোগে নানা উন্নয়নকাজের খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। সেসব স্থানে রাত-দিন ভয়াবহ যানজট যেমন লেগে থাকে, তেমনি ধুলাবালি-ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে যাত্রী-পথচারীরা। অবশিষ্ট অন্য ১৩ পয়েন্টে বিভিন্ন কারণে হচ্ছে যানজট।ভয়ঙ্কর রোডের আতঙ্ক : রাজধানীর শুধু গুরুত্বপূর্ণ সড়কমোড় ও ট্রাফিক সিগন্যালগুলোয় কয়েকশ’ গজ আয়তনের যানজট সৃষ্টি হলেও চি?িহ্নত কয়েকটি রোডের পুরোটাই যানজটে আটকে থাকছে। এসব রোড নিত্য যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মালিবাগ রেল ক্রসিং পর্যন্ত, শনিরআখড়া-যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান পর্যন্ত, গুলিস্তান-সদরঘাট পর্যন্ত, শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত, নীলক্ষেত মোড়-নিউমার্কেট-কলাবাগান পর্যন্ত, বনানী ক্রসিং-মহাখালী-নাবিস্কো বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়ক যাত্রীদের কাছে ‘যানজটের ভয়ঙ্কর স্থান’ হিসেবেই পরিচিত। সায়েদাবাদ জনপথ মোড় থেকে মুগদা স্টেডিয়াম, মালিবাগ মোড় থেকে উত্তর বাড্ডা, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর মোড় থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত রাস্তার পূর্ব পাশে দিনের বিভিন্ন সময়ে যানজট লেগেই থাকে।
সবুজবাগে কনটেইনার ট্রেইলার : রাজধানীর সবুজবাগ বৌদ্ধ মন্দির থেকে টিটিপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত বিশ্বরোডের দুই পাশ দখল হয়ে গেছে। বিশাল কনটেইনারবাহী ট্রেইলার বিশ্বরোডে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকায় প্রতিদিন ছোট-বড় অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে, যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে দুই বছরে ১০ ব্যক্তি মারা গেছেন, পঙ্গু হয়েছেন শতাধিক। কমলাপুর শহীদ মোস্তফা স্টেডিয়ামের সামনে থেকে খিলগাঁও বিশ্বরোডের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ২৫ ও ৪৫ ফুট দীর্ঘ এবং ১০ ফুট প্রস্থের দুই ধরনের ট্রেইলার গাড়ি বিশ্বরোডের দুই পাশের অর্ধেক দখল করে রেখেছে। বৌদ্ধ মন্দির সড়কে ৫০-৬০টি ট্রেইলার গাড়ির পাশাপাশি অসংখ্য কাভার্ড ভ্যানের গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করছে।
রেল ক্রসিং : সমাধানহীন যন্ত্রণা : রাজধানীতে খিলগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, সোনারগাঁও-এফডিসি, মহাখালী, কুড়িল রেল ক্রসিংয়ের কারণেও যানজট অনেকাংশে বেড়ে যায়। প্রতিটি ট্রেন চলাচলের আগে-পরে অন্তত ১০-১২ মিনিট লেগে যায়। ফলে ব্যস্ত সময়ে রেল ক্রসিং এলাকায় তীব্র যানজট হচ্ছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, রাজধানীর ২৯টি রেল ক্রসিং পেরিয়ে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৮০টি ট্রেন চলাচল করে। গড়ে ২০ মিনিট অন্তর ট্রেন চলাচল করে।
স্কুল গেটে নিত্য ভোগান্তি : রাজধানীর স্কুলগুলোর সামনে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের জটলা, এলোমেলো গাড়ি পার্কিং, প্রাইভেট কার, রিকশার ইচ্ছামতো ঢোকা ও বেরিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। শহরের মূল সড়কের যানজট পেরিয়ে অলিগলি, আবাসিক এলাকাগুলোতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে যানজটের এ ভোগান্তি অসহনীয়। যানজটের এমনই কিছু দৃশ্য নিত্যদিন চোখে পড়ে সিদ্ধেশ্বরী, কাকরাইল, মতিঝিল, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন স্কুলের সামনে। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, ধানমন্ডির ওয়াইএমসিএ স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কাকরাইল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল, মতিঝিল বয়েজ ও গার্লস হাইস্কুল, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, উত্তরার স্কলাসটিকার সামনে স্কুল শুরুর এবং ছুটির সময়ে যানজট হয়।