শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মনোনয়নপত্র জমায় বাধা অভিযোগ জমছে ইসিতে

গোলাম রাব্বানী

মনোনয়নপত্র জমায় বাধা অভিযোগ জমছে ইসিতে

বাধার কারণে পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি অনেক আগ্রহী মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী। এমনকি মনোনয়নপত্র না নিতে কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে চাঁদপুরের মতলব ও চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া; কুমিল্লার দাউদকান্দি ও ফেনীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পৌরসভা নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হতে না হতেই নির্বাচন কমিশনে (ইসি) প্রার্থীদের অভিযোগ জমা পড়তে শুরু করেছে। গতকালও ইসিতে কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। এর আগে বৃহস্পতিবারও ইসিতে মৌখিক ও টেলিফোনে অনেক প্রার্থী অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি বলেও অভিযোগ করেছেন প্রার্থীরা।

মনোনয়নপত্র জমা না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লার দাউদকান্দি পৌরসভা রিটার্নিং অফিসারের বিরুদ্ধে। শাহজাহান মিয়া নামের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ইসিতে লিখিত অভিযোগ করেছেন। আবেদনে তিনি বলেছেন, ‘আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সব কাগজপত্র নিয়ে উপজেলা নির্বাচন অফিসে গেলে রিটার্নিং কর্মকর্তা আমার মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আমার মনোনয়নপত্র নিলে তার প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে বলে তিনি আমাকে ফিরিয়ে দেন। পরে কার্যালয়ের মেইন গেটে তালা লাগিয়ে দেন।’ এ ক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার মনোনয়নপত্র গ্রহণের জন্য ইসির কাছে আবেদন জানান এই স্বতন্ত্র প্রার্থী। জানা গেছে, তিনি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে আছেন। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন আগেই। এদিকে শুধু তিনিই নন, তার স্ত্রী নাজমা আক্তারও মনোনয়নপত্র তুলেছেন কিন্তু জমা দিতে পারেননি বলে ইসির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। গতকাল তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কাছে এ লিখিত অভিযোগ দেন। একইভাবে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ড, রাউজান, ও সন্দ্বীপেও অনেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি বলে ইসিকে জানিয়েছেন। তবে তারা ভয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ করার সাহস পাননি। ফেনী পৌরসভায় অনেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসে বাধার মুখে ফিরে গেছেন। আগের রাতেই অনেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে বৃহস্পতিবার ইসির কাছে বিভিন্ন এলাকা থেকে মৌখিক অভিযোগ এসেছিল। ওইদিন তাত্ক্ষণিকভাবে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার কথাও বলেছিল ইসি। এর আগে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, চাঁদপুরের মতলব, উত্তর চট্টগ্রামের রাউজানসহ বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে অভিযোগ এসেছে। এসবের আংশিক সত্যতা রয়েছে, পুরোপুরি নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে অস্বাভাবিক কিছু ঘটার সুযোগ নেই। তবে কেউ আগে থেকেই অবিশ্বাস ও অনাস্থা পোষণ করলে কমিশনের কিছু করার নেই। জানা গেছে, অভিযোগকারীদের বেশির ভাগ বিএনপি মনোনীত হলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছেন। তবে কমিশন সদস্যরা জানিয়েছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ইসি যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না। ১৯ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ইসির বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে। বৈঠকে ইসির পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।

‘সরকারি দলের নেতারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন’ : আচরণবিধি লঙ্ঘনের ‘মহোত্সব’ চলছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। দলের মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন অভিযোগ করে বলেন, দেশের বিভিন্ন পৌরসভায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং তাদের সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা আচরণবিধি লঙ্ঘনের মহোত্সব চালাচ্ছেন। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো ভূমিকা পালন করছে না।

গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন তিনি। রিপন বলেন, সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসাররা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘ব্যর্থ’ হয়েছেন।  এ সময় বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, আবদুল লতিফ জনি, শামীমুর রহমান শামীম, আসাদুল করিম শাহীন, তগদির হোসেন জসিম, হেলেন  জেরিন খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ঢাকার ধামরাই, ময়মনসিংহের গৌরিপুর, ভোলার দৌলতখান, যশোরের কেশবপুর, বরগুনা জেলার বেতাগীসহ দেশের বিভিন্ন পৌরসভায় আওয়ামী লীগের এমপি, দলীয় নেতা এবং তাদের সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের দ্বারা আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট এলাকার রিটার্নিং অফিসাররা কোনো প্রকার ব্যবস্থা না নিয়ে চুপ করে আছেন। এসব রিটার্নিং অফিসারকে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানাই। এখন দেখার বিষয়, নির্বাচন কমিশন বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়। তিনি অভিযোগ করেন, ফেনী জেলার সদর পৌরসভা, দাগনভূঞা, পরশুরাম পৌরসভার ৩৩টি কাউন্সিলর পদে অন্য কাউকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়নি সরকারি দলের লোকজন। এ ছাড়া ফেনী, দাগনভূঞা পৌরসভায় বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা মনোনয়ন ফরম জমা দিতে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। ফেনীতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মনোনয়ন ফরম ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।  দেশের বিভিন্ন এলাকায় শাসক দলের পক্ষ থেকে এভাবে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলেও দাবি করেন বিএনপির এই নেতা। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করি, যতটুকু ব্যর্থতা আছে, তা সত্ত্বেও নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক করতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী যাতে নির্ভয়ে প্রচারণা চালাতে পারেন এবং কর্মীদের যাতে আর গ্রেফতার করা না হয়। ভোটাররা যাতে উত্সবমুখর পরিবেশে তাদের ভোট প্রয়োগ করতে পারেন।

২২টির বেশি দল অংশ নিচ্ছে: এবারের পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টিসহ ২২টিরও বেশি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে। নির্বাচনে মেয়র পদে ১,২২৩ জন এবং সাধারণ পদে ৯,৭৯৮ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ২,৬৬৮ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সর্বমোট ১৩ হাজার ৬৮৯ জন প্রার্থী এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। গতকাল রাতে নির্বাচন কমিশন এ তথ্য জানিয়েছে।

২৩৫ পৌরসভায় গতকাল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল। প্রথমবারের মতো দলভিত্তিক পৌর মেয়র পদে এ ভোট হচ্ছে। এতে ২২টিও বেশি দল মনোনীত একক প্রার্থী দেওয়ার কথা এরই মধ্যে ইসিকে জানিয়েছে। সূত্র জানায়, দলের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ১০০ ভোটারের সমর্থনযুক্ত তালিকা দিতে হবে প্রার্থীকে। তবে সাবেক মেয়র হলে সমর্থন তালিকা দিতে হবে না। সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে নির্দলীয়ভাবে ভোট হচ্ছে।

২৩৫ পৌরসভায় ভোট হবে এবার প্রায় চার হাজার পদে। এর মধ্যে মেয়র পদ ২৩৫টি, সাধারণ কাউন্সিলর পদ ২,৯৫২টি ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদ ৭৩৮টি। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র বাছাই চলবে আজ ৫ ডিসেম্বর ও কাল ৬ ডিসেম্বর এবং প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৩ ডিসেম্বর। ৩০ ডিসেম্বর ভোট অনুষ্ঠিত হবে।

জানা গেছে, নির্দলীয়ভাবে সর্বশেষ ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে আড়াইশ পৌরসভায় মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ১৫ হাজারেরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিল। এর মধ্যে মেয়র পদে ১ হাজার ২০০ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩ হাজার ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১০ হাজার ৩০০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ইসি কর্মকর্তা জানান, এবার ৪০টি নিবন্ধিত দলের অর্ধেকেরও বেশি অংশ নিচ্ছে মেয়র পদের ভোটে। নির্দলীয় ভোটের সময় প্রার্থিতায় তেমন অসুবিধা না থাকলেও এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ১০০ ভোটারের সমর্থন দিতে হয়েছে। সেই সঙ্গে দলের একজন মাত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পেরেছেন। এ জন্য অন্য বারের চেয়ে এবার মেয়র পদে প্রার্থীর সংখ্যা কমেছে। দলের একক প্রার্থী ও স্বতন্ত্রের সমর্থন তালিকা দেওয়া অনেকের জন্য কঠিন হয়েছে।

সর্বশেষ খবর