সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাড়ছে প্রাইভেট কারের আধিপত্য

বিশেষ প্রতিনিধি

বাড়ছে প্রাইভেট কারের আধিপত্য

রাজধানীতে গণপরিবহন সংকটের কারণে প্রাইভেট কারের আধিপত্য দিন দিন বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান যানজট ও ভালো মানের যাত্রীবাহী বাস না থাকায় বিদ্যমান গণপরিবহনের ওপর নির্ভর করতে পারছে না নগরবাসী। আর যেসব গণপরিবহন রয়েছে সেগুলোর সেবার মানও যাচ্ছেতাই। ফলে রাজপথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রাইভেট কারের মতো ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি। যাদের সুযোগ রয়েছে তারা প্রাইভেট কার নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন যখন তখন। দেখা গেছে, এক পরিবারেরই পাঁচজন বেরিয়ে পড়েছেন পাঁচটি গাড়ি নিয়ে। ফলে ওই পরিবারের দখলেই চলে গেছে রাজপথের বড় একটি জায়গা। এভাবে রাস্তা দখলের প্রতিযোগিতায় স্থবির হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। দুর্বিষহ যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নেই।

সড়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর হিসাবে রাজধানীতে বর্তমানে ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি রয়েছে দুই লাখ দুই হাজারেরও কিছু বেশি। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। নগরীতে মানুষের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। কিন্তু বাড়তি যাত্রী চাহিদার বিপরীতে গণপরিবহন না বেড়ে বরং কমেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির (মেট্রো আরটিসি) বাস রুটের তালিকা অনুযায়ী ১৬৬টি রুটে সাত হাজার ৩৬২টি গাড়ির সিলিং থাকলেও বর্তমানে অর্ধেকের বেশি রুটে যানবাহন নেই। সিটিতে চলছে চার হাজারের কিছু বেশি বাস। পরিবহন মালিকরা বলেছেন, যাত্রী বাড়লেও রাজধানীতে যানজটের কারণে বাসের ট্রিপ সংখ্যা (আসা-যাওয়া) কমে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিকদের। এ জন্য নতুন গাড়ি রাস্তায় নামানোর ব্যাপারে মালিকদের আগ্রহ কম। এ ছাড়া চাঁদাবাজি-হয়রানির কারণেও পরিবহন ব্যবসা নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে। রাস্তায় গাড়ি নামলেই মোটা অংকের চাঁদা দিতে হয় নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে। রয়েছে ট্রাফিক পুলিশের হয়রানি। গত কয়েক বছরে টায়ার-টিউবসহ খুচরা যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। এসব কারণে রাজধানীর সড়কগুলোতে অনুমোদিত ৯৮টি পরিবহন কোম্পানির মধ্যে পর‌্যায়ক্রমে ২৪টি কোম্পানিই তাদের সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে। জানা গেছে, বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় গত কয়েক বছরে নগরীর বিভিন্ন রুটে প্রায় তিন হাজার বাস-মিনিবাস বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু রুটে নতুন প্রায় হাজার খানেক বাস নেমেছে বলে মালিক সমিতি জানিয়েছে। বিআরটিএর একজন উপ-পরিচালক বলেন, যানজট নিরসনে বিভিন্ন সময় প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও এ নিয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং সহজ ঋণ সুবিধার কারণে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিস্তার ঘটেছে রাজধানীর রাজপথে। গত আট বছরে রাজধানীতে প্রায় ছয় হাজার বাসের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হলেও সেগুলোর প্রায় অর্ধেকই এখন ঢাকার রাস্তায় নেই। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বেশ কিছু রুটে নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির বাস চলাচল করছে। এসব রুটে অন্য বাস ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এক কোম্পানির বাস দিয়ে একটি রুটের যাত্রীদের জিম্মি করে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কোথাও অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়ার উপায় নেই। এসব কারণে গণপরিবহন চাহিদার প্রায় অর্ধেক বাস-মিনিবাসে ঝুঁকি নিয়ে দুর্ভোগের যাত্রা সারেন সাধারণ মানুষ। ট্যাক্সি ক্যাবের আকাল এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকদের দৌরাত্ন্যে সাধারণ যাত্রীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে যাত্রীদের জিম্মি করে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পরিবহন কোম্পানিগুলো। এর পাশাপাশি নগর পরিবহনে সিটিং, ডাইরেক্ট, গেটলকের নামে নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলছে। মোটরযান আইন, সরকার নির্ধারিত ভাড়া সব কিছু উপেক্ষা করে যথেচ্ছ হয়রানিতে লিপ্ত পরিবহন মালিক শ্রমিকরা। ফলে যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে মালিকদের নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া। সেটাও কিলোমিটার হিসেবে নয়, পরিবহন কোম্পানির নিজেদের ইচ্ছামতো চাপিয়ে দেওয়া। অল্প দূরত্বের যাত্রীকে গুনতে হচ্ছে পুরো পথের ভাড়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অল্প দূরত্বের যাত্রীদের বাসেও তোলা হচ্ছে না। রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে মতিঝিলে অফিস করেন বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে অফিসে যেতে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। সকালে মিরপুর-পল্লবী থেকে যেসব বাস ছেড়ে আসে সেগুলোর প্রায় সবই ‘সিটিং’, ‘গেটলক’ হিসেবে দরজা বন্ধ করে মাঝপথের হাজার হাজার যাত্রীর সামনে দিয়ে গন্তব্যের দিকে চলে যায়। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। তালতলা, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়ার যাত্রীরা এ সময় বাসে উঠতে পারেন না। এ জন্য তাদের সকাল ৯টায় অফিস ধরতে ৭টার আগেই রাস্তায় নামতে হয়। নগর ঘুরে দেখা গেছে, বাস-মিনিবাস চালকদের সীমাহীন দৌরাত্ন্য এবং ক্রমবর্ধমান যানজটের নেপথ্যে পুলিশের বাড়াবাড়িও ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন বাসের চালকরা ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছেন, বাস স্টপেজে ট্রাফিক সার্জেন্টদের হয়রানি-চাঁদাবাজির কারণে নির্ধারিত স্টপেজের বাইরে গিয়ে চালকরা যাত্রী ওঠানামা করতে বাধ্য হচ্ছেন। বাস চালকরা বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে ট্রাফিক পুলিশ কাগজপত্র পরীক্ষার নামে গাড়ি আটকে চাঁদা দাবি করে। এর ফলে রাস্তায় যানজট লেগে যায়। গত বুধবার সকাল সোয়া ১০টায় মহাখালী ফ্লাইওভারের উত্তর প্রান্তে দুই ট্রাফিক পুলিশ একটি বাসের কাগজপত্র পরীক্ষার কারণে ব্যস্ত সময়ে কাকলী সিগন্যাল পর্যন্ত যানজট লেগে যায়। অথচ এ সময় পুরো ফ্লাইওভারটি ফাঁকা পড়ে ছিল। উত্তরা থেকে বারিধারায় নিয়মিত যাতায়াতকারী ইব্রাহিম মণ্ডল বলেন, বাস চালকরা যেখানে সেখানে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা ও যাত্রী নামানোতে ব্যস্ত থাকে। সড়কজুড়ে বাস আড়াআড়ি করে রেখে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করা- এসবই যানজট সৃষ্টির কারণ। এ ছাড়া বাস ছেড়ে আসার প্রতিটি স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় মাস্তানরা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের হাতেই থাকে নিয়ন্ত্রণ। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের (ডিটিসিএ-প্রাক্তন ডিটিসিবি) সাবেক অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, রাজধানীর জন্য তৈরি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ছোট গাড়ি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গণপরিবহন ব্যবস্থা আধুনিকায়ন, মেট্রোরেল এবং বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) ওপর। কিন্তু এসটিপি বাস্তবায়নের কাজ চলছে খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্নভাবে। রাস্তায় স্বাচ্ছন্দ্যের গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে না পারলে প্রাইভেট কারের আধিপত্য ঠেকানো যাবে না। যানজট থেকে আমাদের মুক্তিও মিলবে না।

সর্বশেষ খবর