মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাড়াবাড়ি থামছে না পাকিস্তানের নতুন অপতত্পরতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাড়াবাড়ি থামছে না পাকিস্তানের নতুন অপতত্পরতা

যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর এখন বাকিদের নিয়ে উত্কণ্ঠিত পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে পাকিস্তান অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার উদ্ধত্য দেখানোর বাড়াবাড়ি অব্যাহত রেখেছে। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর আপিলের চূড়ান্ত রায়ের আগে শুরু হয়েছে আরেক দফা অপতত্পরতা। এখন কৌশল নেওয়া হয়েছে চীন, সৌদি আরব ও তুরস্কের মাধ্যমে বাংলাদেশকে চাপ দেওয়ার। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ও তেহরিক-ই-ইনসাফের দাবি অনুসারে এ দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনাও করেছে ইসলামাবাদ। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার একে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রাইব্যুনালের বিচার শুরুর পরপরই বিশ্বকাঁপানো কিছু নেতার ফোনও থামাতে পারেনি বিচারের প্রক্রিয়া। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, জাতীয় গ্লানি থেকে মুক্তির এ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্বের কোনো প্রান্তের কারও নেতিবাচক বক্তব্য সহ্য করা হবে না। অবশ্য রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এখন আর তেমন কোনো বক্তব্য আসার সম্ভাবনাও নেই।

পাকিস্তানের ইংরেজি গণমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে গতকাল প্রকাশিত এক  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জম্মু কাশ্মীরের জনসভায় পাকিস্তান জামায়াতের আমির সিরাজুল হক বলেছেন, ‘আমি পাকিস্তান সরকারকে বলছি, বাংলাদেশে জামায়াত নেতা ও বিরোধী রাজনীতিকদের ফাঁসি বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিন। সরকারের কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনারা চীন, সৌদি আরব ও তুরস্কের সঙ্গে দ্রুত আলোচনায় বসে তাদের দিয়ে বাংলাদেশকে চাপ দিন। এ ইস্যুতে পাকিস্তান সরকারের মৃদু প্রতিক্রিয়া দেখে আমি মর্মাহত।’ এর এক সপ্তাহ আগে করাচিতে যৌথভাবে র্যালি করে তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান ও পাকিস্তান জামায়াতের আমির সিরাজুল হক একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছিলেন। গতকালই পাকিস্তানের আরেক দৈনিক ডনের অনলাইন সংস্করণের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসির পর মর্মাহত ইসলামাবাদের পররাষ্ট্র দফতরকে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে বলা হয়েছিল। সেই দাবি শুধু রাজপধে বিরোধী দল তোলেনি, পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই একই দাবি উঠেছিল। পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক আদালতে না গেলেও এখন সমমনা মুসলিম দুই রাষ্ট্র তুরস্ক ও সৌদি আরব এবং বন্ধুরাষ্ট্র চীনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে দরকষাকষির দাবি পূরণে নেমে পড়েছে।’ জানা যায়, পাকিস্তানে চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ আসন্ন। নির্বাচনের আগে তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান ও পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির সিরাজুল হক একাট্টা হয়েছেন। একই মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছেন বিভিন্ন র্যালিতে। ইমরান খান শুধু জামায়াতের দাবির সঙ্গে কণ্ঠই মেলাচ্ছেন না, তিনি যুদ্ধাপরাধী সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসির আগে তা কার্যকর না করার আবদার জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠিও লিখেছিলেন। এর আগে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বাংলাদেশের কাছে ভুল স্বীকার করলেও এখন তার সরকার একাত্তরে গণহত্যার কথা অস্বীকার করে বক্তব্য দিচ্ছে। যদিও নওয়াজ শরিফের ক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন আছে পাকিস্তানি গণমাধ্যমের।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, পাকিস্তান চেষ্টা করলেও চীন ও সৌদি আরবের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে এ বিষয়ে কোনো অনুরোধ জানানো হবে না। বিচার শুরুর পর থেকেই সৌদি আরব এর বিরুদ্ধে থাকতে পারে বলে নানান ধরনের ধারণা তৈরির চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। সৌদি আরব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে আকারে ইঙ্গিতেও কিছু বলেনি। বরং উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া কূটনৈতিক বার্তায় দেখা যায়, সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সবুজ প্যাডে বাদশাহর কাছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১২ সালের মে-জুন মাসে এক বার্তায় (স্মারক নম্বর ৭/২, নথি নম্বর ৪/১ তারিখ ১৪৩৩ সনের রজব মাস) যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে জামায়াতে ইসলামীর অনুরোধ ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করার পর ৬১৬৪৬ নম্বর বাদশাহি ফরমানে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সৌদি আরব হস্তক্ষেপ করবে না। অবশ্য ২০১৩ সালের ৪ মে সৌদি যুবরাজ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল ফয়সাল মন্তব্য করেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি অংশ। আর সৌদি সরকার সব সময়ই ন্যায়বিচারের পক্ষে।’ অন্যদিকে, চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী নয়। তাই প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য কখনই করেনি বেইজিং। তবে বিচার শুরুর পর বা সর্বশেষ গত দুই বছরে ঢাকা ও বেইজিংয়ের সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতা বেড়েছে বহুগুণ। গত সপ্তাহে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ দূত ও দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ভাইস মিনিস্টার চেন ফেংজিয়াংয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ জানান, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বাংলাদেশের পাশে চীন অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।’ অন্যদিকে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে পাকিস্তানের পাশাপাশি আরেকটি দেশই বক্তব্য দিয়েছে তা হলো তুরস্ক। এর কারণ বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর মূল শিকড় যেমন পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী তেমনি পাকিস্তান জামায়াত ও তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা জেডিপি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ব্রাদারহুডের ভাবাদর্শেই বিশ্বাসী। অবশ্য তুরস্কের অবস্থানেও এখন নমনীয়তা এসেছে। শুরুতে বিচার বন্ধের জন্য চিঠি ও বিবৃতি দিলেও সর্বশেষ সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের পর ইস্তাম্বুলের পররাষ্ট্র দফতর দণ্ড হিসেবে ফাঁসি না রাখার বৈশ্বিক নীতিতে অংশ নিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানায়।

এদিকে, ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে সরকারের অবস্থান বেশ পরিষ্কার। পাকিস্তানকে সর্বশেষ প্রতিবাদ জানানোর পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, বিচার শুরুর পরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের তরফে যেসব প্রশ্ন, মন্তব্য, মতামত ও পরামর্শ এসেছে সে বিষয়গুলো যথাসাধ্য বিবেচনায় নিয়ে ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ নিরসন করা হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে বিশ্বের কোনো দেশের পক্ষ থেকেই আর কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া গ্রহণের অবস্থানে নেই বাংলাদেশ এবং এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ।

সর্বশেষ খবর