বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পুলিশে নিয়োগ নিয়ে তোলপাড়

তদবিরে ব্যস্ত জনপ্রতিনিধি রাজনৈতিক নেতাসহ পুলিশের কর্তারাও

সাখাওয়াত কাওসার

নিয়োগ নিয়ে আবারও পুলিশ বিভাগে তোলপাড় চলছে। নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল। আর এই নিয়োগ নিয়েই ব্যস্ত সারা দেশের সরকারি দলের জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা। শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, পুলিশের নিজেদের মধ্যেও লবিংয়ের শেষ নেই। একদিকে তদবির, অন্যদিকে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ। কোথাও কোথাও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নিয়োগ ভাগাভাগির সমঝোতা চলছে বলেও জানা গেছে। বর্তমানে এ নিয়ে কাজ করছে দালাল চক্র। জনপ্রতি অর্থের পরিমাণও জেলা থেকে উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন গ্রামেও আলোচনা চলছে। নিয়োগ পেতে সরকারি দলের কর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন চিন্তার ও ঘরানার মানুষেরা বসে নেই। অনেক সময় ভিন্ন মতাবলম্বীরাও টাকা দিয়ে নিয়োগ নিতে চেষ্টা করছেন। এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, অর্থ ও তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগ হলে পুলিশের সার্বিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। নিয়োগপ্রাপ্তরা রাষ্ট্রের সেবা করার পরিবর্তে তাদের যে অর্থ এখন ব্যয় হচ্ছে, তা তুলে নেওয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আইনের শাসন। এর আগেও পুলিশের নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু তারপরও সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যে কারণে নতুন নিয়োগে পুরনো স্টাইল চলছে। আবার অনেক এলাকায় ভুয়া নিয়োগে দালালরা তত্পর হয়ে উঠেছে। দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকের নিঃস্ব হওয়ারও খবর পাওয়া যাচ্ছে।

পুলিশে নিয়োগ প্রসঙ্গে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ হাদিস উদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঘুষ দিয়ে কেউ যদি পুলিশ বাহিনীতে প্রবেশ করে তাহলে প্রথমেই সে চেষ্টা করবে কীভাবে তার বিনিয়োগকৃত টাকা তুলে নেওয়া যায়। এটা পুলিশ বাহিনী তথা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এটা যে কোনো উপায়ে হোক না কেন রোধ করা উচিত। অতীতের একটি পদ্ধতির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ১৯৮৪-৮৬ সালে আমি পুলিশ দফতরের এআইজি (সহকারী পুলিশ পরিদর্শক) ছিলাম। ৯০ দশক পর্যন্ত নিয়োগে স্বচ্ছতার জন্য তখন একজন এআইজিকে জেলা নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান করা হতো। কারণ তাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনীতিবিদ কিংবা তদবিরবাজরা চিনতও না। প্রয়োজনে সেই নিয়মটি পুনরায় পুনর্বহাল করা যেতে পারে। এদিকে টাকার বিনিময়ে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর রমনা থানা এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক প্রতারককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জাহাঙ্গীর কুমিল্লা জেলার এক প্রার্থীর কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। গ্রেফতারকৃত এবং প্রার্থীর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায়। এ ধরনের অভিযোগ দেশের বিভিন্ন  এলাকা থেকেও এসেছে। জানা গেছে, চাকরি প্রার্থীদের অনেকেই দালালের মাধ্যমে টাকা দিতে তাদের জমিজমা পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী তারা অগ্রিম অর্ধেক টাকা চাকরি হওয়ার আগেই দালালের কাছে দিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তারা বাদ পড়েছেন। এখন তারা দালালের কাছে দেওয়া টাকা নিয়ে উদ্বিগ্নতার মধ্যে সময় পার করছেন। দালাল প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তাদের সঙ্গে কথা বলারও সাহস পাচ্ছেন না অনেক প্রতারিত। রমনা থেকে গ্রেফতার জাহাঙ্গীরের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার জন্য এক প্রতারক তার কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে— এমন খবরের ভিত্তিতেই আমরা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করি। সে আরও কতজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল সে বিষয়টি জানার চেষ্টা চলছে। অপরাধ বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আমরা চাই আমাদের পুলিশ হবে পেশাদার। তাদের মূল দায়িত্ব হবে জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া। সেটা নিশ্চিত করতে হবে স্বচ্ছতা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে। তবে তদবির কিংবা টাকার বিনিময়ে কেউ নিয়োগ পেলে তার প্রথম টার্গেটই থাকে টাকা তুলে আনা। তার মানসিকতাই হয়ে পড়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই যে কোনো মূল্যে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা দরকার। নইলে এর কুফল কর্তৃপক্ষকেই এক সময় বহন করতে হবে। এর ফল তাদেরও পেতে হবে।  পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, সারা দেশের ৬৪ জেলায় এবার একসঙ্গে ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে সাড়ে ৮ হাজার পুরুষ কনস্টেবল ও দেড় হাজার নারী কনস্টেবল নিয়োগ করা হবে। গত ৩ ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন জেলায় শারীরিক মাপ ও শারীরিক পরীক্ষা নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। বিভিন্ন জেলার প্রভাবশালী নেতারা পুলিশ সুপারদের কাছে দলীয় কর্মী হিসেবে নিয়োগের জন্য চাপ দিয়ে তালিকা ধরিয়ে দিচ্ছেন। এসব তালিকায় ১০ থেকে ৪০ জনের নাম পর্যন্ত রয়েছে। এসব তালিকা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপাররা এক প্রকারের বিপাকে রয়েছেন। সূত্র জানায়, এর আগে মৌলভীবাজার ও ঠাকুরগাঁও জেলায় স্থানীয় এমপির তালিকা মতো নিয়োগ না দেওয়ায় পারস্পরিক দোষারোপের অভিযোগ ওঠে। বিষয়গুলো নিয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে তদন্ত করানো হয়। সেসব তদন্তেও স্থানীয় এমপির কথামতো নিয়োগ না দেওয়ায় জনপ্রতিনিধিরা পুলিশ সুপারদের প্রতি ক্ষিপ্ত ছিলেন বলে তদন্তে ওঠে আসে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা অনেকেই স্থানীয় এমপির কাছ থেকে তালিকা পেয়েছেন। মন্ত্রী-এমপির চাপের কথা স্বীকার করে একজন পুলিশ সুপার বলেন, অনেক সময় নানাবিধ কারণে কথা শুনতে হয়। তা না হলে নানারকম ভুল তথ্য দিয়ে তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বিষোদগার করতে থাকেন। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এবার ঢাকা জেলায় সর্বাধিক সংখ্যক কনস্টেবল নিয়োগ করা হবে। এ জেলায় ৫৯২ জন পুরুষ কনস্টেবল ও ১০৪ জন নারী কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক নজরুল ইসলাম বলেন, পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ম্যানুপুলেশন’ করার কোনো সুযোগ নেই। নিয়ম অনুযায়ী শারীরিক মাপে যোগ্য হওয়ার পর লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। সেই পরীক্ষার খাতায় শুধু কোড নম্বর থাকে। সেটি আলাদা একটি কমিটি দেখে। যার ফলে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তদবির কিংবা কোনো প্রেসারের সুযোগ নেই। দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়ার অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে এবং তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলে- সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আমাদের নাটোর প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, নাটোরে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের নামে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে বলে শহরজুড়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। ১২২ জন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের প্রক্রিয়ায় কেউ কেউ কোটিপতি বনে যাচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি রীতিমতো নাটোরের টক অব দ্য টাউন। এ নিয়ে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের প্রক্রিয়ার অংশ নেওয়া পরীক্ষার্থীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জানা গেছে, নাটোরে ১২২ জন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত রবিবার সারা দিন নাটোর পুলিশ লাইনে আসেন জেলার প্রায় আট হাজার যুবক। তাদের মধ্য থেকে উচ্চতা ও ওজনসহ নানা কিছু দেখে ৮০০ জনকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়। মেডিকেল শেষে মঙ্গলবার তাদের সেখানেই নেওয়া হয় লিখিত পরীক্ষা। সবাই মাঠে পরীক্ষা দিলেও ৬৫ জন বাছাইকৃত পরীক্ষার্থীকে নাটোরের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার মুখার্জি এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুন্সী শাহাবুদ্দীনের বিশেষ তত্ত্বাবধানে ঘরের মধ্যে বিশেষভাবে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। চারজন পুলিশ কর্মকর্তা এই ৬৫ জন পরীক্ষার্থীকে ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য সহযোগিতা করেন। পুলিশের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, নাটোরের চার সংসদ সদস্য ও স্থানীয় শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের এবং মুক্তিযোদ্ধা ও আদিবাসীসহ নানা কোটা দিতে গিয়েই প্রায় সব শেষ। তাই নাটোরের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার মুখার্জি এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুন্সী শাহাবুদ্দীনের প্রার্থীরা যেন বাদ না পড়ে যায়— তাই এই বিশেষ তত্ত্বাবধানে ঘরের মধ্যে বিশেষভাবে এই পরীক্ষা নেওয়া। বিষয়টি চাপা রাখতে নাটোর প্রেসক্লাবের তিনজন সাংবাদিক নেতাকেও কোটা দেওয়া হয়েছে বলে তারা দাবি করেন। প্রতিটি পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে এবার আট থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছে বলেও তারা জানান। আলাদা বিশেষ পরীক্ষা নেওয়ার কারণ জানতে নাটোরের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার মুখার্জিকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরা থেকে বিরত থাকেন। পরে খুদে বার্তা পাঠানোর পরও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুন্সী শাহাবুদ্দীন জানান, তিনি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন। এ বিষয়ে তাকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য না লেখার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলার জন্য বলেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর