বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এ যেন নিত্য অভিশাপ

সাঈদুর রহমান রিমন

এ যেন নিত্য অভিশাপ

রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার যানজট স্থায়ী রূপ পেয়ে বসেছে। যানজট ভোগান্তির অভিশাপ থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাচ্ছেন না নগরবাসী। রাস্তা, অলিগলি সর্বত্রই কয়েক সারিতে গাড়ি পার্কিং করে রাখায় রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীজুড়ে চলছে সীমাহীন বিশৃঙ্খলা। মতিঝিল-দিলকুশার মতো ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকারও নিস্তার নেই। অন্যদিকে রাস্তা-ফুটপাথের বেপরোয়া দখলবাজি আটকে দিয়েছে পুরান ঢাকাবাসীর জীবনযাত্রাকে। এসব এলাকা সরেজমিন ঘুরে ফিরে যানজট ভয়াবহতার নানাচিত্র লক্ষ্য করা গেছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীকে বিশৃঙ্খলামুক্ত করা যাচ্ছে না। ক্রমেই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। দুঃসহ যানজটে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী-বারিধারার বেশিরভাগ এলাকা আটকে থাকছে। স্থবির হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। সেখানে রাস্তাজুড়ে দুই-তিন সারিতে শত শত গাড়ির এলোপাতাড়ি পার্কিংকে কেন্দ্র করেই যানজট ভয়াবহতার সূত্রপাত ঘটে। পাশাপাশি রাস্তা, গলির বেশিরভাগ জায়গা জবরদখল হয়ে আছে, চলছে যথেচ্ছ ব্যবহার। বছরের পর বছর ধরে অভিন্ন অবস্থা বিরাজ করলেও এর ধকল থেকে রেহাই দিতে কারও কোনো উদ্যোগ নেই। দিনের শুরুতে এই অভিজাত এলাকায় শুরু হওয়া যানজটের ধকলই ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চলতে থাকে সবচেয়ে বড় নাগরিক যন্ত্রণা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও লিয়াজোঁ কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে গুলশান-বনানী, বারিধারাতেই। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের দূতাবাসও রয়েছে। আছে নামিদামি শিক্ষা, বাণিজ্যিক ও মিল-কারখানার প্রধান কার্যালয়ও। ফলে হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যবসায়ী, গ্রাহকসহ সব শ্রেণির মানুষের নিয়মিত যাতায়াত গুলশান-বনানীতে। তারা নিয়ে আসেন প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পাজেরো জিপসহ হরেক রকমের গাড়ি। এতসব গাড়ি বহনকৃত যাত্রীদের আবার ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আশপাশেই দিনভর পার্কিং করে রাখা হয়। ফলে ৫ সহস্রাধিক গাড়ির ভিড়ে সমগ্র গুলশান-বনানী সারা দিনই স্থবির থাকে।

গুলশান-বনানী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দু-চারটি বাদে আর কোনো অফিস প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব পার্কিং জোন নেই। নিয়মানুযায়ী প্রতিটি বহুতল ভবনের নিচে পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান থাকার কথা। গ্রাউন্ডফ্লোর অথবা আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর কেবল গাড়ি রাখার জন্যই নির্মাণের বিধান রয়েছে। গুলশান-বনানীতেও বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়ে থাকে রাজউক।  সরেজমিন দেখা যায়, বেশির ভাগ সড়কেই একাধিক সারিতে গাড়ি পার্কিং করে রাখা রয়েছে। গুলশানে অসংখ্য অফিস ও বাণিজ্যিক কার্যালয় থাকলেও কোনো ভবনে পার্কিং ব্যবস্থার সুযোগ নেই। কোনো ভবনে সীমিত পার্কিংব্যবস্থা থাকলেও তা সংশ্লিষ্ট ভবনের অফিসগুলো ব্যবহার করতে পারে না। গুলশান-১ চক্কর থেকে গুলশান-২, শুটিং ক্লাব হয়ে তেজগাঁও-মহাখালী অভিমুখে যাওয়া রাস্তা এবং গুলশান-২ থেকে বনানীর কাকলী মোড়মুখী প্রধান রাস্তাজুড়ে দিনভর শত শত গাড়ি অবৈধ পার্কিং দেখার আছে অনেকেই, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার যেন কেউ নেই। ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা কয়েকটি গাড়ির স্টিকার দেখিয়ে বলেন, ‘এসব গাড়ির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সাধ্য আমার নেই।’ স্টিকারগুলোয় ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কাজে ব্যবহূত’, ‘আইনি সহায়তা  কেন্দ্র’, ‘সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী’, ‘পুলিশ’, ‘মন্ত্রণালয়ের কাজে নিয়োজিত’, ‘সরকারি ডাক্তার’ এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়নকারী একাধিক সংগঠনের নাম ইত্যাদি লেখা রয়েছে।

রক্ষা হয়নি পার্কিং জোন : খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সিটি করপোরেশন নির্মিত নির্ধারিত পার্কিং জোনগুলোও রক্ষা করা যায়নি। অভিজাত এলাকা বনানী-গুলশানের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত স্থানগুলো দখল করে হকারদের  দোকানপাট ও স্থায়ী হাটবাজার বসেছে।

গুলশান-২-এর ডিআইটি মার্কেটে গড়ে তোলা পার্কিংয়ের জায়গায় প্রায় ১৫টি ভাতের হোটেল, চা-পান, সিগারেটসহ ফলের দোকান গড়ে উঠেছে। এদিকে গুলশান ১ নম্বর উত্তর ডিসিসি পাকা মার্কেটে গিয়ে দেখা যায় মালিক সমিতির অফিসের পেছনে খালি জায়গাটি সম্পূর্ণ হকারদের দখলে। উপরে পলিথিন দিয়ে তারাও মার্কেট বানিয়েছেন। জানা যায়, জায়গাটি গাড়ি পার্কিংয়ের। জোর করে জায়গাটি দখলে রাখা হয়েছে। গুলশান-১-এর ২১ নম্বর রোডে হকারদের প্রায় ১৫ থেকে ২০টি টং দোকান দেখা যায়।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলকে বিশৃঙ্খলামুক্ত করা যাচ্ছে না। ক্রমেই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত মতিঝিলে অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দিনভর শত শত গাড়ির ভিড়ে সমগ্র মতিঝিল অচল পড়ে থাকে। সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কমবেশি ১০ ঘণ্টাই থাকে ভয়াবহ যানজট। রীতিমতো হতশ্রী অবস্থা। পায়ে চলার মতো সামান্য জায়গাও যেন ফাঁকা পাওয়া যায় না। ১৬টি রুটের প্রায় ৭০০ বাস-মিনিবাস চলাচল করে শাপলা চত্বর ও এর আশপাশ থেকেই। বেশিরভাগ গাড়ি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঠিক সামনেই যাত্রী তোলে, নামায়। আছে কয়েক হাজার রিকশার ছড়াছড়ি। সকাল ৯টার আগেই খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, কমলাপুর, মুগদা, মানিকনগরের কয়েক হাজার রিকশা যেন শাপলা চত্বরে একযোগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এ জটটাই লেগে থাকে দুপুর পর্যন্ত। অদূরেই দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় যানজটের আরও ভয়ানক পরিস্থিতি। পুরান ঢাকায় ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হওয়ায় লোকজনকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তীব্র যানজটে পড়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকছে যানবাহন। অবৈধ তিনটি বাস ও ছয়টি ট্রাকস্ট্যান্ড, রাস্তা দখল করে ব্যবসায়ীদের মালামাল রাখা, টং দোকান তৈরি করা এবং মাত্রাতিরিক্ত অযান্ত্রিক যানবাহনের চাপে পুরান ঢাকার কয়েকটি সড়কে এ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা গেছে। এলাকাবাসী, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরান ঢাকার বাবুবাজার নদীরঘাট, নয়াবাজার ও ভিক্টোরিয়া পার্কের চারপাশে তিনটি অবৈধ বাসস্ট্যান্ড রয়েছে। এ ছাড়া বাবুবাজার নদীরঘাট, কাচ ও আয়না মার্কেটের সামনে, আরমানিটোলা মাঠের চারপাশ, নবাব ইউসুফ রোড, ইংলিশ রোড পার্কের চারপাশ ও ধোলাইখালে গড়ে উঠেছে ছয়টি অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড। এসব যানবাহন রাস্তার বেশির ভাগ জায়গা দখল করে রাখায় রাস্তা কমে গেছে। এ কারণে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণির ইংলিশ রোড থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে রয়েছে রড, অ্যাঙ্গেল, প্লেনসিট ও স্যানেটারি মালামালের দোকান। এ রাস্তাটি প্রায় ১০০ ফুট চওড়া হলেও রাস্তার উভয় পাশে ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, ট্রাক, পিকআপ, প্রাইভেটকার ও মালামাল রাখা হচ্ছে। রড ও আয়রন ব্যবসায়ীদের অসাবধানতা এবং যেখানে-সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ মালামাল উঠানো-নামানোর কারণে প্রায়ই ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটছে। বাবুবাজার নদীরঘাট থেকে নয়াবাজার পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর উভয় পাশের ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে গড়ে উঠেছে শতাধিক টং দোকান। রাস্তা দখল করে রাখা হয়েছে রিকশা, ভ্যান, ট্রলি ও পিকআপ। বাবুবাজার নদীরঘাট থেকে নয়াবাজার পর্যন্ত এলাকায় রয়েছে ওষুধ, চাল ও কাগজের মার্কেট। দোকানপাট খোলা হলে লোকজন ও যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। অবৈধভাবে রাস্তা দখলে থাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। আরমানিটোলা মাঠের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে রয়েছে রাসায়নিক পদার্থের দোকান। মাঠের চারপাশে ট্রাক ও পিকআপ-স্ট্যান্ড। এ রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করে আরমানিটোলা, আনন্দময়ী, আহম্মাদিয়া, আহমেদ বাওয়ানি একাডেমিসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শত শত শিক্ষার্থী। ট্রাকস্ট্যান্ডের কারণে শিক্ষার্থী ছাড়াও স্থানীয় লোকজনের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। নয়াবাজার বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর গোড়া থেকে রায়সাহেব বাজার মোড় পর্যন্ত রাস্তার পাশে রয়েছে নয়াবাজার বাসস্ট্যান্ড এবং ডিআইটি মার্কেটের সামনে ফুটপাথ দখল করে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ফলের দোকান। কিছু দূর এগোতেই নবাব ইউসুফ রোডের উত্তর পাশে আরেকটি ট্রাকস্ট্যান্ড। সেখানে রাস্তা দখল করে ট্রাক ও পিকআপভ্যান রাখা হয়েছে। আরও কিছু দূর এগোতেই ইংলিশ রোড পার্কের দুই পাশে আরেকটি ট্রাক ও পিকআপ-স্ট্যান্ড। এসবের কারণে এলাকায় যানজট লেগেই আছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর