বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শহর ঢেকে যায় প্রচারের বিলবোর্ডে

লাকমিনা জেসমিন সোমা

শহর ঢেকে যায় প্রচারের বিলবোর্ডে

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কজুড়ে আছে এমন বিলবোর্ড -বাংলাদেশ প্রতিদিন

হঠাৎ অস্থায়ী বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে রাজধানী। একদিকে চলছে সিটি করপোরেশনের বিলবোর্ড উচ্ছেদ অভিযান, অন্যদিকে বিজয়ের মাস ঘিরে নতুন করে এসব বিলবোর্ড স্থাপন করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পিছিয়ে নেই কাউন্সিলররাও। স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিসহ নিজ দলের নেতা বা বড়ভাইদের খুশি করতে বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করেই এই প্রচারণা শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ বিলবোর্ড উচ্ছেদ করা সম্ভব হলেও এখনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছোট-বড় বিলবোর্ড ও পোস্টারে ছেয়ে আছে শহর। বিশেষ করে গত নভেম্বরে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও চলতি মাসের বিজয় দিবস উপলক্ষে নতুন এই বিলবোর্ডগুলো স্থাপন করেছেন নেতা-কর্মীরা। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের ১৩তম চিন্তাবিদ হওয়াকেও ইস্যু করে আÍপ্রচারে নেমেছেন। এ ছাড়া এখনো যেখানে-সেখানে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে ঝুলছে শোকাবহ আগস্ট সংবলিত বিভিন্ন বিলবোর্ড, ব্যানার ও পোস্টার। যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আÍপ্রচারকারী নেতার ছবির বিপরীতে বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি স্থান পেয়েছে ছোট্ট একটু জায়গায়। তাও আবার পরবর্তীতে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ম্লান হয়ে গেছে তাদের ছবি। জানা গেছে, ‘বড়ভাই বন্দনা’ থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এসব বিলবোর্ড স্থাপন করেছেন স্থানীয় নেতারা। সরেজমিন বিলবোর্ডগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, মূলত আÍপ্রচারের জন্যই এই বিলবোর্ডগুলো স্থাপন করা হয়েছে। বিজয় দিবস উপলক্ষে স্থাপিত অধিকাংশ বিলবোর্ডের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিজয়ের চেতনার চেয়ে নিজেদের প্রচারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। সেখানে আÍপ্রচারকারী নেতার ছবির কারণে ঢেকে গেছে মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। ঢেকে গেছে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিও। রাজধানীর বিজয় সরণি এলাকায় দেখা যায় কয়েকজন কাউন্সিলরের এমন প্রচারণা। সেখানে উত্তর সিটির স্থানীয় দুজন কাউন্সিলর তাদের এলাকার আওয়ামী লীগ এমপির ছবি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ১৩তম চিন্তাবিদ হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন। রাস্তার ওপর বাঁশ-খুঁটি লাগিয়ে টানানো এই বিলবোর্ডের কারণে ঢেকে গেছে ক্রিসেন্ট লেকসংলগ্ন বিজয় সরণির বিমান ভাস্কর্যটিও। দক্ষিণ সিটির অন্তর্ভুক্ত কাকরাইলে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলররা মিলে বিশাল বিলবোর্ডে জানিয়েছেন বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। শুভেচ্ছার আড়ালে বিলবোর্ডজুড়ে সাঁটিয়েছেন নিজেদের ছবিও। রাজধানীতে রাজনৈতিক দলের পোস্টার, ব্যানার ও বিলবোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে যুবলীগের প্রচারণা। গুলিস্তানে জিপিওর সামনে এখনো ঝুলছে ঢাকা মহানগর যুবলীগ নেতাদের ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ছবি। এ ছাড়া ফার্মগেট, পল্টন মোড়, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী  থেকে শুরু করে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা বাড্ডাসহ রাজধানীজুড়ে অলি-গলিতে ঝুলছে এসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পোস্টার, ব্যানার এবং বিলবোর্ড। এটি নিয়ে খোদ সরকারদলীয় একজন মন্ত্রীও সম্প্রতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের কড়া সমালোচনা করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিজয়ের মাসে এসব বিলবোর্ড ও আÍপ্রচারণাকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজিও চলছে হরদম। অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদ অভিযানের মধ্যেই হঠাৎ এমন প্রচারণায় অনেকটা বিপাকে পড়েছে সিটি করপোরেশন। বিশেষ করে উত্তর সিটি যখন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ ও অবৈধ বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলতে পেরেছে তখন হঠাৎই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব বিলবোর্ড শহরকে ফের বিলবোর্ডের শহর বানিয়ে ফেলেছে। গতকালও রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় মেয়র আনিসুল হক বলেন, আমরা ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলতে পেরেছি। আগামী ২০-২৫ দিনের মধ্যে বাকিগুলোও সরিয়ে ফেলা হবে। তখন মানুষ আরও ভালোভাবে খোলা আকাশ দেখতে পাবে। বিলবোর্ড সংক্রান্ত নতুন নীতিমালায় এলইডি বিলবোর্ডের প্রচলন ছাড়াও বিভিন্ন আধুনিক সিস্টেম ও নিয়ম-কানুন চালু হবে বলেও জানান মেয়র। এ প্রসঙ্গে উত্তর সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা বলেন, নতুন করে যে বিলবোর্ডগুলোর কথা বলছেন সেগুলো আসলে বিলবোর্ডের মধ্যে পড়ে না। ওগুলো বিজয়ের মাস উপলক্ষে অস্থায়ীভাবে লাগানো হয়েছে। বিজয়ের মাস শেষ হয়ে গেলেই ওগুলো আবার তুলে নেবেন তারা। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বৈধ বিলবোর্ড ছিল ২ হাজার ১৫১টি। দক্ষিণ সিটিতে এই সংখ্যা ছিল ৪৭৬টি। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই আড়াই হাজারের বাইরে দুই সিটিতে বর্তমানে অবৈধ বিলবোর্ডের সংখ্যা কমপক্ষে আরও তিন হাজার। তবে গত ৩০ জুন মেয়াদ শেষ হওয়ায় সিটি করপোরেশনের বৈধ-অবৈধ সব বিলবোর্ডই অবৈধ ঘোষণা করেন উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। এরপরও বার বার সময় বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও সাড়া না পাওয়ায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিলবোর্ড ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। ঘোষণা অনুসারে গত ১০ অক্টোবরের মধ্যে বিলবোর্ড সরিয়ে না নিলে মামলা-মোকদ্দমা বা জরিমানাসহ অন্য যে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছিলেন মেয়র। তবে দক্ষিণের ব্যাপারে এখনো এমন কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের কথা জানাননি মেয়র সাঈদ খোকন। দুই সিটির জন্য বিলবোর্ড সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে এরই মধ্যে কমিটি গঠন হয়েছে।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম এনামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটিতে নগরবিদ মোবাশ্বের হোসেন, স্থপতি ইকবাল হাবিব, আউটডোর অ্যাডভারটাইজিং অ্যাসোসিয়েশনের দুই সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিভিন্ন পর‌্যায়ের মোট ১৪ জন সদস্য রয়েছেন। কমিটির সদস্যরা এরই মধ্যে খসড়া নীতিমালা তৈরি করে ফেলেছেন বলেও জানা গেছে।

সর্বশেষ খবর