বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আইন আছে মানে না কেউ

চালক-পুলিশ দুই পক্ষই স্বেচ্ছাচারী

নিজস্ব প্রতিবেদক

আইন আছে মানে না কেউ

সড়কে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ, গাড়ির চালক ও মালিকের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মোটরযান আইনের বিভিন্ন বিধান থাকলেও বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে গাড়ির চালকদের বেশির ভাগেরই তেমন কোনো ধারণা থাকে না। ফলে দুর্ঘটনাসহ সড়কপথে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দিন দিন বেড়েই চলছে। মোটরযান আইনে ২০ বছরের নিচে কোনো ব্যক্তি  পেশাদার চালকের আসনে বসতে পারবে না। এ সংক্রান্ত আইনের ১৩৮ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া কোনো মোটরযান চালালে বা অন্যকে চালাতে দিলে সর্বোচ্চ চার মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫০০ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। গাড়ির কন্ডাক্টর হতে হলে কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে এবং তারও কন্ডাক্টরের লাইসেন্স থাকতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে আইন অনুসারে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারে।

রাস্তার পাশে গাড়ির গতিসীমা সংক্রান্ত নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও অনেক চালক তা মানেন না এবং নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। মোটরযান আইনের ১৪২ নম্বর ধারা অনুসারে, এভাবে দ্রুতগতিতে  কোনো মোটরযান চালালে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রথমবার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ এক মাস কারাদণ্ড কিংবা সর্বাধিক ৩০০ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। শুধু তাই নয়, পরে একই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদণ্ড কিংবা সর্বাধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অনধিক এক মাস  মেয়াদের জন্য লাইসেন্স বাতিল করার বিধান রয়েছে। মোটরযান আইনের ১৩৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন সংযোজিত পাওয়া গেলে ১০০ টাকা জরিমানা করা হবে। ১৪০ ধারায় রয়েছে, ওয়ান-ওয়ে অমান্য করলে, নিষিদ্ধ ইউটার্ন করলে, নিষিদ্ধ সময়ে যানবাহন চলাচল করলে ২৫০ টাকা জরিমানা করা হবে। আইনানুগ সর্বোচ্চ গতিসীমা লঙ্ঘন করলে ৩০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে ১৪২ নম্বর ধারায়। ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, যানবাহন যে কোনো ধরনের ত্রুটিযুক্ত থাকলে এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহন করলে জরিমানা হবে ৩০০ টাকা। যানবাহন থেকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বের হলে জরিমানা হবে ২০০ টাকা। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাবের চালক গন্তব্যস্থলে যেতে অস্বীকার করলে ৭০০ টাকা জরিমানা করার বিধান আছে ১৫২ নম্বর ধারায়। ১৪৩ ধারায় বেপরোয়া কিংবা বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালনার জন্য সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচশ টাকা জরিমানা হবে এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স একটা নির্ধারিত মেয়াদের জন্য সাসপেন্ড থাকবে।

সড়কে যানবাহন রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপরাধে ৫০০ টাকা জরিমানা এবং মোটরযান বা খুচরা যন্ত্রাংশ বাজেয়াপ্ত করার বিধান আছে ১৫৭ নম্বর ধারায়। কিন্তু এসব অপরাধ অহরহ ঘটলেও আইনের কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না বললেই চলে। বরং সড়কে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা ট্রাফিক সংকেত লঙ্ঘনের মতো সাধারণ কিছু ধারায় মামলা দায়ের করে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে থাকে। এসব মামলায় চালকরা ৫০-১০০ টাকা জরিমানা দিয়েই খালাস পায়। ফলে আইন ভঙ্গ করেও নির্ধারিত ধারা অনুযায়ী শাস্তি না পাওয়ায় দিন দিনই যানবাহন চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তারা সড়কপথে ব্যস্ততম রাস্তাতেও রীতিমতো রেসিং শুরু করেন, যখন তখন রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। অন্যদিকে, পুলিশও ‘কোটা পূরণের’ জন্য অহরহ গাড়িতে জরিমানা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, প্রতিটি এলাকায় পুলিশ আইন লঙ্ঘন না করলেও অনেক গাড়িকে জরিমানা করছে। এর নেপথ্যে রয়েছে ‘কোটা পূরণের’ বিষয়। অনেক ভুক্তভোগী এ ব্যাপারে নানা অভিযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করেছেন; কিন্তু এই দৌরাত্ন্য কমেনি।

হাইকোর্টের আদেশও উপেক্ষিত : প্রতিনিয়ত আইন ভঙ্গের প্রবণতায় সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার কারণেই ভয়াবহ যানজট হচ্ছে। অথচ মোটরযান আইন অমান্য করার দায়ে কাউকে কোনো শাস্তি দেওয়ার নজির নেই। ফলে বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গাড়ি মালিক-চালকদের যেমন আইন ভঙ্গের প্রবণতা বাড়ছে তেমনি বাড়ছে বিশৃঙ্খলা-এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও যানজটের সীমাহীন ধকল। যানবাহনের গতিসীমা মনিটর করতে হাইকোর্ট থেকে ট্রাফিক সদর দফতরকে নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পালিত হয় না। ২০০৯ সালের ২৯ জুন হাইকোর্টের এ নির্দেশের পর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে সীমিতভাবে গতি মাপক যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হলেও রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে গতি মাপক যন্ত্র মোটেও ব্যবহার করা হয় না। ফলে রাজধানীতে গাড়ি চালকরা নিয়মিত গতি প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন। উল্লেখ্য, বিএম খাইরুল কবির ও মমতাজউদ্দিনের নেতৃত্বে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বিআরটিএ ও ট্রাফিক সদর দফতরকে যানবাহনের গতি মনিটরের নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে যানবাহনগুলোতে ‘স্পিড গভর্নর সিল’ লাগানোর নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু বিআরটিএ প্রকৌশলীরা জানান, ডিজেলচালিত যানবাহন ছাড়া অন্য কোনো যানবাহনে ‘স্পিড গভর্নর সিল’ লাগানো যায় না। তাই যানবাহনে সেটি আর লাগানো হয়নি। ১৯৮৩ সালের সড়ক আইনে হালকা যানবাহনের গতিসীমা ১১৩ কি.মি. , বাসের ৫৬ কি.মি., হেভি ট্রাক ৪৮ কি.মি.। তবে শহরের মধ্যে কোনো আলাদা গতিসীমা পর্যন্ত নির্ধারণ করা নেই। তুচ্ছতাচ্ছিল্যতায় বাড়ছে দুর্ঘটনা। শাস্তি পেতে হয় না বলেই চালক-হেলপারদের মধ্যে দিন দিন অসতর্ক, অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা বেড়েছে। ফলে পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলছে দুর্ঘটনা আর হতাহতের সংখ্যাও। নানা ফাঁকফোকর গলিয়ে ঘাতক গাড়ির মালিক, অসতর্ক চালক, জাল লাইসেন্সধারীরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে জীবননাশ করেও নির্বিঘেœ নিরাপদে বিচরণ করতে পারেন। নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, শাস্তি না পাওয়া, পুলিশের দায়িত্বহীনতা, বিআরটিএর দুর্নীতি দিন দিনই সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রাকে বাড়াচ্ছে। দুর্ঘটনায় একজন মানুষের মৃত্যু মানেই একটি পরিবারের সারা জীবনের দীর্ঘশ্বাস। পথে পথে নানা জঞ্জাল রাজধানীর সড়ক, ফুটপাথ, অলিগলিসহ জনচলাচলের পথগুলো নানা স্ত‚প আর নির্মাণসামগ্রীতে আটকে পড়ে আছে। কোনো কোনো রাস্তার বেশির ভাগ অংশই দখল করে মাসের পর মাস পণ্যসামগ্রীর স্ত‚প বানিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে পথচারীরা। রাস্তাজুড়ে এলোপাতাড়িভাবে ফেলে রাখা রড, বালু, তার, ইট, পাথর, লোহালক্কড়ে প্রায়ই আঘাত পাচ্ছে লোকজন, রিকশা-গাড়ির দুর্ঘটনাও ঘটছে মাঝে-মধ্যেই। বার বার আবেদন-নিবেদন করেও জনবহুল রাস্তাগুলো থেকে অবৈধভাবে রাখা নির্মাণসামগ্রীর জঞ্জালসমূহ অপসারণ করা যাচ্ছে না।  মাঝে-মধ্যে সিটি করপোরেশন ও ডিএমপির পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে ‘সতর্কতামূলক বিজ্ঞাপন’ ছাপিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করে।

অথচ রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত কারও বিরুদ্ধে গত ২০ বছরেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর