বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিলের কৃষকের কষ্টের জীবন

বছরের অর্ধেক সময় জলাবদ্ধ জমি

রাহাত খান, সাতলা (উজিরপুর) থেকে ফিরে

বিলের কৃষকের কষ্টের জীবন

উজিরপুরের বিলগুলো বছরের অধিকাংশ সময় থাকে জলাবদ্ধ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সাতসকালে ছোট নৌকা-লগি আর একটি পাত্র (পাতিল) নিয়ে বিলের পানিতে নেমেছেন সত্তর ছুঁই ছুঁই কালাচাঁন দেউরী। অপুষ্টির ছাপ তার চোখে-মুখে। রুগ্ন শরীরেও বিলের পানিতে নেমেছেন, কারণ ঘরে খাবার নেই। বিলের পানিতে জাল-বড়শি দিয়ে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে কিছু চাল-সদাই কিনে তবেই তিনি বাড়ি ফিরবেন। মাছ না পেলে ৫ সদস্যের পরিবারের সবাইকে অভুক্তও থাকতে হয় মাঝে-মধ্যে। জমিজমা যা আছে, তা পানির নিচে। শারীরিকভাবে সক্ষম এই এলাকার তরুণ-যুবকরা কাজের সন্ধানে শহর-বন্দরে ভিড় করলেও কালাচাঁন এবং তার মতো হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন চরম বিপাকে। জমি থাকলেও বছরের একটি দীর্ঘ সময় চাষ করতে পারেন না তারা।

বরিশাল জেলা শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে উজিরপুর উপজেলার সাতলা, হারতা, জল্লা ইউনিয়নসহ আশপাশের বিলাঞ্চলের চিত্র এটি। শুধু উজিরপুরই নয়, সংলগ্ন আগৈলঝাড়া ও বানারীপাড়া উপজেলা এবং পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার অন্তত ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে ৩ থেকে ৫ ফুট পানি থাকে জ্যৈষ্ঠ থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত প্রায় সাত মাস। বিলাঞ্চল, মানে বছরের বেশির ভাগ সময় বসতবাড়ি ছাড়া কৃষি জমি তলিয়ে থাকে পানিতে। এ সময় কোনো ফসল ফলানো যায় না। বিলে আগাছার মতো জম্মে থাকে লাল ও সাদা রঙের শাপলা আর শাপলা। পথচারী ও সৌন্দর্যপিপাসুরা যেদিকে দুই চোখ যায়, শাপলা ফুল দেখে সাময়িক রোমাঞ্চিত হলেও এগুলো এখানকার কৃষকের কাছে কার্যত মূল্যহীন। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে আসা কার্তিক মাসের প্রথম দিকে পানি কমতে শুরু করলে বিলে নেমে পড়েন ভূমি মালিক-কৃষকরা। প্রথমে দিনমজুর দিয়ে ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে জমি চাষ উপযোগী করা হয়। খরচ হয় অতিরিক্ত টাকা। অগ্রহায়ণে বীজতলা তৈরি এবং পৌষ মাসে রোপণ করা হয় ইরি ধান। ফাল্গুনে শীষ বের হয় ধানগাছ থেকে। চৈত্রে ইরি ধানে ছেয়ে যায় মাঠের পর মাঠ। বৈশাখে সোনালি ধানের শীষের দোলায় একটি বছর খেয়ে-পরে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন বিলাঞ্চলের অভাবগ্রস্ত কৃষকরা। বিলম্বে যারা বীজতলা তৈরি কিংবা ধানের চারা রোপণ করেন, তারা পড়েন সমস্যায়। কারণ জ্যৈষ্ঠের শুরুতেই আবার পানিতে তলিয়ে যায় বিল। তাই বৈশাখের মধ্যেই পাকা, আধা-পাকা আর কাঁচা ধান কেটে নিতে হয় কৃষকদের। বীজতলা তৈরি থেকে ধান কাটা পর্যন্ত এই সময়ে এলাকার কেউ বেকার থাকে না বলে জানালেন হারতার প্রবীণ বাসিন্দা চিত্ত রঞ্জন বিশ্বাস। উজিরপুরের রাজাপুর গ্রামের কালাচাঁন দেউরী বলেন, ‘শীতের সময় কেউ দিনমজুরি করে আবার কেউ নিজের জমি চাষ করে ছয় মাস থেকে এক বছরের খোরাক (চাল) জোগান। বিলে পানি থাকায় বছরের বাকিটা সময় থাকতে হয় কর্মহীন। এ সময় কষ্টে কাটাতে হয়।’ গ্রামের আরেক প্রবীণ পরিমল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘পূর্বপুরুষরা যুগ যুগ ধরে বছরে একবারই শীতের মৌসুমে আউশ-আমন ধান চাষ করতেন। কিন্তু এতে ফলন হয় কম। তাই প্রায় এক যুগ ধরে আউশ-আমনের পরিবর্তে ইরি ধানের চাষ শুরু সাফল্য পাচ্ছেন কৃষক। যাদের জমি আছে, তারা এক ফসল দিয়েই সারা বছরের খোরাকের ব্যবস্থা করেন। যাদের জমি নেই, তারা ইরি মৌসুমে দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাকি সময় কেউ বিলের পানিতে মাছ শিকার আবার কেউ অন্যত্র গিয়ে শ্রমিকের কাজ করেন।’ কৃষক হারুন হাওলাদার বলেন, ‘বছরে একটি ফসল উৎপাদন হওয়ায় কৃষকরা ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারছেন না।’ হারুনের মতে, এই জমিতে বছরে দুই-তিন ফসল ফলানোর ব্যবস্থা করা গেলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক-সামাজিক চিত্র পাল্টে যাবে। এক্ষেত্রে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। হারতা বিলের সুরেশ ও সুখলাল বিশ্বাস বললেন, ‘এক ফসল হওয়ায় অভাব-অনটনে চলে সংসার। সরকার জলাবদ্ধ জমিতে চাষের উপযোগী ধান কিংবা পানি অপসারণের ব্যবস্থা করলে দুই-তিন ফসল ফলানো সম্ভব। এটা হলে আমরা সংসার-পরিজন নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারতাম। বেড়িবাঁধের মাঝে মাঝে কালভার্ট, স্লুইস গেট নির্মাণ এবং বিলের মধ্যে খাল খননসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে হাজার হাজার কৃষক নতুন করে জেগে উঠতে পারতেন।’ বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি প্রফেসর এম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বিলাঞ্চলের কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের উচিত জলাবদ্ধতা নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া। সেটা না হলে এ জমিতে চাষের পদ্ধতি আবিষ্কার করে কৃষকের বৈষম্য দূর করতে হবে। নইলে এই কৃষকরা আরও পিছিয়ে পড়বে।’ বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আবদুল আজিজ ফরাজী বলেন, ‘বছরে অন্তত ছয় মাস চার উপজেলা নাজিরপুর, বানারীপাড়া, উজিরপুর ও আগৈলঝাড়ার বেশির ভাগ কৃষি জমি পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এ সময়ে ভাসমান ধাপের ওপর (কচুরিপনার স্ত‚প) সবজি, আদা-হলুদ ও পেঁপে চারা উৎপাদন করে থাকেন কৃষক। পানি উন্নয়ন বোর্ড জলাবদ্ধ জমির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করলে এই কৃষকরা অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকের মতো সারা বছর ফসল উৎপাদন করতে পারবেন। এতে তাদের দৈন্যদশা দূর হবে।’ বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বরিশাল নিচু এলাকা। এ চার উপজেলায় ৫০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমি আছে। এর মধ্যে মাত্র ২০ ভাগে ফসল ফলানো যায়। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে উজিরপুরের সাতলা-বাগধা, আগৈলঝাড়ার রামশীল-পয়সারহাট প্রকল্প এবং বিআইপির ইরিগেশন প্রকল্পের (বেড়িবাঁধ, খাল খনন, স্লুইস গেট নির্মাণ) কাজ চলছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে দুই ফসল ফলানো যাবে। এরপরও যেসব জমিতে পানি থাকবে, সেগুলোতে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করা হবে।’ তবে হচ্ছে-হবে শুনতে শুনতে মানুষ বিরক্ত হয়ে গেছে দাবি করে সনাক সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড যে প্রকল্পের কথা বলছে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে পিছিয়ে পড়া কৃষকদের বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এই দায়িত্ব সরকারের।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর