রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মুখোমুখি পুলিশের ক্যাডার ও বিভাগীয় কর্মকর্তারা

সাখাওয়াত কাওসার

পদোন্নতি নিয়ে পুলিশের ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তা ও বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এখন মুখোমুখি। ‘জ্যেষ্ঠতা’ নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ সদর দফতর থেকে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। ২২৭টি অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের শূন্য পদকে টার্গেট করে এ দ্বন্দ্ব নিরসনে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। এ অবস্থায় উচ্চ আদালত আগামী ৫ জানুয়ারির মধ্যে জনপ্রশাসন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ পাঁচজনকে রুলের জবাব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এমন জটিলতায় পিছিয়ে গেছে পদোন্নতিসংক্রান্ত বোর্ডের বৈঠকও। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত। তবে পদোন্নতিতে দেশের বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা অনুসরণ করা হবে। কেউ বঞ্চিত হবে না। জানা গেছে, পুলিশের ২৭ ও ২৮তম বিসিএসের কর্মকর্তারা যারা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পাবেন, এমন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপারদের সংযুক্তি নিয়ে শুরু হয়েছে এ দ্বন্দ্ব। ২৭ ও ২৮তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া অনেক কর্মকর্তার মতে, চাকরিতে যোগদানের পর যাদের তারা পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে দেখেছেন ‘ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা’ দিয়ে তাদের সিনিয়র বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে; যা অনেক অপমানকর। তবে বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন কারণে তারা পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন। বিশেষ করে ২০১১ সালের বিধির অনুসরণ করেই তাদের ‘ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা’ দেওয়া হয়েছে। এটা তাদের অধিকার। কর্তৃপক্ষ তাদের বিষয়টি অনুধাবন করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ২০১১ সালে বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত ৪১ জন সহকারী পুলিশ সুপার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ বলে ২৫তম ব্যাচের চেয়ে জ্যেষ্ঠতা দাবি করেছিলেন। পরে এ-সংক্রান্ত ‘জিও’ হয়েছিল। যদিও পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের হস্তক্ষেপে তা বাতিল করা হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ওইসব বিভাগীয় কর্মকর্তাকে আমলে নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত ১৩ জন কর্মকর্তা ২৭তম বিসিএসের চেয়ে এবং আটজন কর্মকর্তা ২৮তম বিসিএসের চেয়ে জ্যেষ্ঠ দাবি করে ‘ধারণাগত জ্যেষ্ঠতার’ সনদ পেয়েছেন। ইতিমধ্যে এ-সংক্রান্ত ‘জিও’ হয়েছে। এর ফলে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি পুলিশে ক্যাডার পদে যোগদান করা বর্তমানে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার, পরবর্তীতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতিপ্রত্যাশী ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে। এবার ২২৭টি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শূন্যপদের বিপরীতে পদোন্নতিসংক্রান্ত বোর্ডের সিদ্ধান্তের পর ‘ডিপিসি’ হবে।

৬ ডিসেম্বর ২৮তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারের পক্ষে সহকারী পুলিশ কমিশনার হাসান আরাফাত এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন। মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও মোস্তফা জামাল ইসলামের দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। কেন পদোন্নতির ক্ষেত্রে ধারণাগত জ্যেষ্ঠতার সনদের প্রচলন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে এ রুল জারি করা হয়। আগামী ৫ জানুয়ারির মধ্যে জনপ্রশাসন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপিসহ পাঁচজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এদিকে ৭ ডিসেম্বর পদোন্নতিসংক্রান্ত বোর্ড বসার কথা ছিল। তবে এ জটিলতায় বৈঠক পিছিয়ে গেছে। পদোন্নতি নিয়ে এ জটিলতা নিরসন করতে ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার দেখা করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সূত্র জানায়, ২৭ ব্যাচের চেয়ে ধারণাগত জ্যেষ্ঠ সনদ আদায় করা ১৩ জন কর্মকর্তা হলেন- সহকারী পুলিশ সুপার মো. আমিনুর রহমান, মো. মনোয়ার হোসেন, মো. আবদুস সালাম, রবিউল ইসলাম, ফরিদ উদ্দীন আহমেদ, মো. ইউসুফ আলী মোল্লা, মো. আকবর হোসেন, প্রণবকুমার রায়, মো. মঈন উদ্দীন, মো. আবদুল মতিন, এস এম শফিউল আজম, রুহুল আমীন সিদ্দিকি, ফোরকান সিকদার ও শাহ্রুম খান।

২৮ ব্যাচের চেয়ে জ্যেষ্ঠতার সনদ আদায় করা আট কর্মকর্তার মধ্যে চৌধুরী তারিকুল আলম, মো. আবদুল হানিফ, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. আবদুর রশীদ, মো. আবদুল হান্নান, শিবলী নোমানের নাম জানা গেছে। এদিকে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোর্কারামুছ সাকলান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস সিনিয়রিটি রুলস-১৯৮৩ কিংবা ১৯৮১-এর নিয়োগবিধির কোথাও ধারণাগত জ্যেষ্ঠতার বিষয়টি উল্লেখ নেই। সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে নজিরবিহীন এ ঘটনার জম্ম দেওয়া হয়েছে।

২৭তম বিসিএসের সহকারী এক জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার এ প্রতিবেদককে বলেন, যদি ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা বহাল রাখা হয়, তবে নারায়ণগঞ্জে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় যে পরিদর্শক আমাকে স্যার অ্যাড্রেস করেছেন, কিছু দিন পর তাকে আমার স্যার ডাকতে হবে। এটা সত্যি খুব বেদনার, যা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

২০১০ সালে চাকরিতে যোগ দেওয়া ২৮ ব্যাচের ১৮০ জনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিভাগীয় পদোন্নতি পেয়ে যারা সহকারী পুলিশ সুপার হয়েছেন, তাদের অন্তত ২২ জন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কয়েক দফায় ‘ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা’র সনদ নিয়েছেন। তাদের অনেকেই ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময় পরিদর্শক হিসেবে ‘স্যার’ সম্বোধন করেছেন। তাদের কেউ ২০১১ সালে, কেউ ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হয়েছেন। যদিও এখন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হওয়ার পদোন্নতি সামনে রেখে ‘ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা’র সনদ নিচ্ছেন। যদিও বিভাগীয় পদোন্নতি পাওয়া একজন সহকারী কমিশনার বলেন, নন-ক্যাডার বিধিমালা ২০১১ অনুযায়ী তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠতার সনদ চেয়ে আবেদন করেন। মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তাদের এ সনদ দেন।

সর্বশেষ খবর