শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ফের হুমকিতে গুলশান লেক

সাঈদুর রহমান রিমন

ফের হুমকিতে গুলশান লেক

রাস্তা ডিঙিয়ে মাটি ভরাট চলছে গুলশান লেক। রাতের আঁঁধারে সেখানে গজিয়ে উঠছে দোকানপাটও —বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

 

মাটি ভরাটের মাধ্যমে রাজধানীর গুলশান লেক জবরদখলের মহোৎসব থেমে নেই। গত মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় লেকের বাড্ডা অংশে ব্যাপকভাবে ভরাটের কাজ চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ট্রাক, ট্রলি, ঠেলাগাড়ির সাহায্যে শ্রমিকরা লেকের আধা কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১০-১২ ফুট প্রশস্ত স্থানজুড়ে এ ভরাট চালাচ্ছেন। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস পালন নিয়ে প্রশাসনসহ সব মহল যখন ব্যস্ত, সেই ফাঁকেই রাতারাতি লেকের বিরাট অংশ জবরদখলের কৌশল খাটানো হয়। স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালী মহল লেকপাড়ের রাস্তা ঘেঁষে সারি সারি দোকানপাট গড়ে তোলার জন্যই লেক ভরাট করছেন।

রাজউক ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গুলশান লেকপাড় ঘেঁষে হাতিরঝিল পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রেও চিহ্নিত দখলবাজরা নানাভাবে বাধা দিয়ে আসছিল। লেকের মধ্যে বাপ-দাদার জমি থাকার দাবি করে তারা রাজউকের নির্মাণাধীন রাস্তার একাংশ জুড়ে দখলবাজি শুরু করে। ৪০ ফুট প্রশস্ত এ রাস্তার বহু স্থানে সিংহভাগ দখল করে ইতিমধ্যে নানা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। দুটি স্থানে গজিয়ে উঠেছে শতাধিক দোকানপাটের হাটবাজার। প্রভাবশালী দখলবাজ চক্রটি মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে রাস্তা নির্মাণের কাজও আটকে দেয়। তাদের সহায়তায় রাজউকের বিরুদ্ধেই আদালতে মামলা ঠুকে এখন লেকের বিরাট অংশ জবরদখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। ফলে শাহজাদপুর মরিয়ম টাওয়ার-২ থেকে হাতিরঝিল পর্যন্ত সংযোগ রাস্তাটি নির্মাণ যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তেমনি গুলশান লেক নতুন করে জবরদখলেরও সুযোগ করে নেওয়া হয়েছে। লেকে মাটি ভরাট ও জবরদখলের অভিযোগের ব্যাপারে রাজউক কর্মকর্তারা দাবি করছেন, সেখানে ঢালাওভাবে জবরদখলের কোনো সুযোগ নেই। রাস্তা নির্মাণের পরপর এর দুই পাশে দখলপূর্বক অস্থায়ী দোকানপাট গজিয়ে উঠলেও খুব শিগগিরই সেসব উচ্ছেদ করা হবে। রাজউকের প্রজেক্ট অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগের দায়িত্বশীল প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেনের ভাষ্যমতে, রাস্তা ঘেঁষে লেকসাইডে কিছু মাটি ভরাট করে বাঁধ নির্মাণের কার্যক্রম চলছে। লেক বা সড়কের কোনো পাশেই জবরদখলের অস্তিত্ব রাখা হবে না। বরং রাস্তাটি টেকসই করতে সারি সারি গাছ রোপণের মাধ্যমে স্থানটি আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলা হবে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নয়নাভিরাম হাতিরঝিল লেক প্রকল্পের সঙ্গে গুলশান-বারিধারার সংযুক্তির লক্ষ্যে গুলশান লেকপাড় ঘেঁষে রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত দুই বছর লেকের একাংশ জুড়ে মাটি ভরাট করে ৪০ ফুট প্রশস্ত লেক ড্রাইভওয়ে নির্মাণের কাজ চলে। মাটি ভরাটের পর রাস্তা পাকাকরণের কাজ শুরু করতেই লেকসংলগ্ন বাড্ডা অংশের কয়েকজন বাসিন্দা বাধা হয়ে দাঁড়ান। তারা দাবি করেন, কোনোরকম হুকুম-দখল ছাড়াই তাদের বাড়িঘর দখল করে রাস্তা নির্মাণের কাজ চালানো হচ্ছে। এ নিয়ে অন্তত ১০ জন বাসিন্দা রাজউকের বিরুদ্ধে জবরদখলের অভিযোগ তুলে আদালতে মামলাও ঠুকে দেন। ফলে আদালত থেকে রাস্তাটি নির্মাণের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ জারি হওয়ায় পাকাকরণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে আইনি বেড়াজাল পেরিয়ে রাজউক অতি সম্প্রতি পুনরায় রাস্তা উন্নয়নের কাজ শুরু করে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, লেকপাড়ের কাঁচা রাস্তাটি নির্মাণের পর থেকেই কূটনৈতিক এলাকার লোকজনসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ সকাল-বিকাল লেকপাড় ধরে হেঁটে বেড়ান। কোনো বায়ুদূষণ নেই, শব্দদূষণ নেই-নেই যানবাহনের ভিড়-ভাড়াক্কা। রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর সময় লেকের বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়। পাশাপাশি রাস্তাটির নির্মাণ সম্পন্ন হলে মহাখালী-গুলশান শুটিং রেঞ্জ দিয়ে গুলশান-১ ঘুরে গুলশান-২ যাওয়ার ক্ষেত্রে যানজটের যে ঝক্কি পোহাতে হয় তা এড়ানো সম্ভব হবে। হাতিরঝিল হয়ে সরাসরি লেকপাড়ের রাস্তা দিয়ে সহজে কয়েক মিনিটেই গুলশান-২ এ যাতায়াত করা যাবে। সরেজমিন গুলশান-বাড্ডা লেক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, লেকের বাড্ডা অংশে রাস্তা দখল হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গুলশান-১ থেকে গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডের ফুটওভারব্রিজ পর্যন্ত লেকঘেঁষা রাস্তার বিরাট অংশ দখল হয়েছে। এতে রাস্তাটি বহু স্থানে সরু হয়ে গেছে। অপরদিকে গুলশান-শাহজাদপুর লিংক রোডসংলগ্ন মরিয়ম টাওয়ারের পাশ থেকে লেকপাড় রাস্তা পুরোটাই দখল করে বাজার বসানো হয়েছে। সেখানে শতাধিক স্থায়ী দোকানপাটও গজিয়ে উঠেছে। দখলবাজরা শুধু রাস্তা দখল করেই ক্ষান্ত থাকছে না, এখন তারা রাস্তা পেরিয়ে লেক দখলদারিতে নেমেছে। স্থানীয়রা জানান, লেকের বাড্ডা অংশের রাস্তার কাজ শুরুর পর থেকেই একশ্রেণির লোকের নজর পড়ে। তারা রাস্তার জমি জবরদখল করে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের ফাঁদ পেতেছে। যখন স্থানটি লেকের পানিতে নিমজ্জিত ছিল তখন কোনো দাবিদার এগিয়ে আসেননি। কিন্তু লেকের পানিতে মাটি ফেলে ৪০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা করার পর থেকেই কেউ কেউ জায়গার দাবিদার সেজে রাতারাতি দখলবাণিজ্যে নেমে পড়ে। তারা রাস্তার ওপর নানা স্থাপনা বানিয়ে এখন পাকাকরণের কাজ বাধাগ্রস্ত করে। রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান মুনশী বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা থেকে অবৈধ দখলদারদের হটিয়ে দিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী নির্দেশ দেন। সেখানে কোনো জবরদখলকারী রাস্তা উন্নয়ন কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে উল্টো ঘটনা ঘটছে। সেখানে রাজউকের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী স্থানীয় দখলবাজ চক্রের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে রাস্তা নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখেছে। এ সুযোগেই জবরদখল হচ্ছে রাস্তা এমনকি লেকও। গুলশান ও বনানী লেক দখলবাজি নিয়ে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এর পরই রাজউক উচ্ছেদ অভিযানের উদ্যোগ নেয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর