শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
মান্নান খানের স্বেচ্ছাচারিতার জের

চুক্তি মানছে না রমনা রেস্তোরাঁর ঠিকাদার

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানের স্বেচ্ছাচারিতার আরেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। মান্নান খানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সূত্রে সর্বনিম্ন দর দিয়েও রাজধানীর রমনা পার্ক রেস্তোরাঁর ঠিকাদারি পেয়েছিলেন ‘ইউরো আসিয়ানো’ নামক প্রতিষ্ঠানটি। এখন তারা চুক্তি মানছে না। নির্ধারিত ৬ হাজার ৯০০ বর্গফুট জায়গা ব্যবহারের অনুমোদন থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি এর পাঁচগুণ বেশি প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুট জায়গা ব্যবহার করছে। চুক্তি লঙ্ঘন করে বেশি জায়গা ব্যবহার করায় ঐতিহাসিক রমনা পার্কের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। গাছপালা, সবুজ ঘাস নষ্ট হয়ে রেস্তোরাঁর ব্যবহার করা জায়গাটি বিরাণভূমিতে পরিণত হচ্ছে। চারপাশে ভালো কোনো রেস্তোরাঁ না থাকায় তারা ক্রেতাদের জিম্মি করে খাবারের দাম বেশি রাখা হচ্ছে, ক্ষেত্র বিশেষে ক্রেতাদের হয়রানি করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম প্রকাশ্যে চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ  নিচ্ছে না। সূত্র জানায়, মহাজোট সরকারের সাবেক গৃহায়ণ ও পূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ইউরো আসিয়ানোর স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন আহমেদ ঝিলু সর্বনিম্ন দর দিয়েও রমনা পার্ক রেস্তোরাঁর ঠিকাদারি কাজটি বাগিয়ে নেন। প্রতিমন্ত্রীর জোরালো হস্তক্ষেপ থাকায় চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েও হুমকির মুখে অন্য দরদাতারা পিছু হটে। এরপর সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে ফাঁকা মাঠে লিজের কাজ পেয়ে যায় ইউরো আসিয়ানো। সরকারি দলের একাধিক নেতা-কর্মী অভিযোগ করেন, নিয়ম-কানুনের মধ্যে চেষ্টা করেও প্রতিমন্ত্রী মান্নান খানের তত্পরতার কারণে রমনা রেস্তোরাঁর ঠিকাদারি কাজ আমরা পাইনি। গণপূর্ত অধিদফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী জানান, কয়েকজন যুবলীগ নেতা রমনা রেস্তোরাঁর ঠিকাদারি কাজ পেতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শুরু থেকেই প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান ইউরো আসিয়ানোর স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন আহমেদ ঝিলুর পক্ষে তত্পর ছিলেন। এ সময় নাসির উদ্দিন ঝিলুর প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়। তারা জানান, প্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সর্বোচ্চ দরদাতা রেখে সর্বনিম্ন দরদাতাকে লিজ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা উচিত হলেও তা করা হয়নি। হয়রানি আর ঝামেলা এড়াতে সর্বোচ্চ দরদাতারা লিজ প্রক্রিয়া থেকে সরে যান। সূত্র আরও জানায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রীর কিছু ঘনিষ্ঠজন এখনো গণপূর্ত অধিদফতরের শীর্ষপদে কর্মরত রয়েছেন। তারা চুক্তি লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইউরো আসিয়ানো’-কে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। এ কারণে চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়ে তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বরং গণপূর্তের কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গণপূর্ত অধিদফতর সূত্র জানায়, ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা পরিশোধের শর্তে রমনা পার্ক রেস্তোরাঁটি ইউরো আসিয়ানো রেস্টুরেন্টকে পাঁচ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ২০১২ সালের ১২ আগস্ট গণপূর্ত অধিদফতরের সঙ্গে ইউরো আসিয়ানোর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৭ সালের ১১ আগস্ট পর্যন্ত এই চুক্তি কার্যকর থাকার কথা। তবে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করলে তা বাতিল করার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, রমনা পার্কের ভিতরে অবস্থিত আচ্ছাদিত ৬ হাজার ৯২৫ বর্গফুট এলাকা রেস্টুরেন্টের কাজে ব্যবহার করতে পারবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চুক্তিতে এর বিভাজন করেও দেওয়া হয়। এর মধ্যে মূল স্ট্রাকচার ৪ হাজার ৮৯৫ দশমিক ২৫ বর্গফুট, বারান্দা ৯৬০ বর্গফুট, রান্নাঘর ৫২৮ বর্গফুট, টয়লেট ১১৩ বর্গফুট, আধাপাকা শেড ৪০৪ বর্গফুট। রেস্টুরেন্ট আঙিনার সামনের ১৬ হাজার ৩৩০ বর্গফুট জায়গা পার্কের দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে বলা হয়েছে চুক্তিতে। এর বাইরে আর কোনো জায়গা ব্যবহারেরও কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি চুক্তিতে। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চুক্তি লঙ্ঘন করে আরও প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট পার্কের জায়গা রেস্টুরেন্টের কাজে ব্যবহার করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমনা রেস্তোরাঁটি প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। কখনো কখনো সরকারি ছুটি কিংবা উৎসবের দিনগুলোতে আরও বেশি সময়ও খোলা রাখা হয়। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার ভোর ৬টা থেকে খোলা হয় রেস্টুরেন্ট। হোটেল কর্মচারীরা জানান, এখানে ৫ হাজার লোকের আয়োজন করার সামর্থ্য আছে। এ জন্য প্রায় ৪২ হাজার বর্গফুট জায়গা ব্যবহার করা হয়। জানা যায়, পার্কের ভিতর রেস্তোরাঁ হওয়ায় এখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হয়। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছাড়াও পরিবারের সদস্যরা পিকনিক মুডে একজোট হয়ে আসেন রমনা রেস্টুরেন্টে। কিন্তু এ রেস্টুরেন্টের সেবায় চরমভাবে অসন্তুষ্ট গ্রাহকরা। টোকেন কেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও খাবার না পেয়ে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে বাধ্য হন অনেকে। বিশেষ করে উৎসব ও ছুটির দিন এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এমন ঘটনার শিকার এক গ্রাহক বলেন, টোকেন নিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও খাবার না পেয়ে টোকেন রেখে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। অন্যান্য রেস্টুরেন্টের তুলনায় রমনাতে খাবারের দাম অনেক বেশি। রেস্তোরাঁর এক কর্মী বলেন, রেস্টুরেন্টে সামর্থ্যের চেয়ে বেশি লোক এলে এমন ঘটনা ঘটে থাকে। তবে যারা নিয়মিত আসেন, একটু দেরি হলেও তারা ধৈর্য ধরে বসে থাকেন। কিন্তু নতুনরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে চলে যান। রমনা পার্ক নষ্ট করে রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনার ব্যাপারে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, রমনা পার্ক একটি ঐতিহাসিক স্থান। এই পার্কটি রাজধানীর পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। সেই পার্কে রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলাটাই ঠিক হয়নি। রমনা পার্কের এই রেস্টুরেন্টের মাধ্যমে গুটিকয়েক ব্যক্তি লাভবান হচ্ছেন। তাই রমনা রেস্তোরাঁর কারণে পার্কের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সংশ্লিষ্টদের সেদিকে খেয়াল রাখার অনুরোধ জানাই। তিনি বলেন, রমনা পার্কের অব্যবস্থাপনা বন্ধ করতে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। একই সঙ্গে উচ্চ আদালতে মামলা করারও চিন্তা করছি। এমনকি রমনা পার্কটিকে রক্ষা করতে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর