শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দেশে মিলল ইউরেনিয়াম এবার জানতে হবে ব্যাপ্তি

জিন্নাতুন নূর

বাংলাদেশে ইউরেনিয়াম নামক মূল্যবান পারমাণবিক জ্বালানির উপস্থিতি আছে কি নেই— প্রশ্নে এক ধরনের তর্ক চলে আসছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই দেশে এ খনিজ পদার্থটির উপস্থিতি আছে দাবিও করলেও কোন এলাকায়, কতটা ব্যাপ্ত এবং তা উত্তোলনযোগ্য কিনা— এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের একটি বিশেষজ্ঞ দল তাদের প্রাপ্ত নমুনা পরীক্ষা করে তাতে এ তেজস্ক্রিয় খনিজের উপস্থিতি পেয়েছে এবং সংগ্রহকৃত নমুনা পরীক্ষার জন্য জাপান ও কোরিয়ায় পাঠানো হয়েছে। প্রাপ্ত নমুনাকে ইউরেনিয়ামের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান এবং পরমাণু শক্তি কমিশনের নিউক্লিয়ার সেফটি সিকিউরিটি অ্যান্ড সেফগার্ড ডিভিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ কে এম ফজলে কিবরিয়াকে নিশ্চিত করেছে জাপান ও কোরিয়া। এই বিজ্ঞানী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সিলেট ও মৌলভীবাজারে ১০-১২টি স্থান থেকে সংগ্রহকৃত পাথরে উচ্চ থেকে মাঝারি মাত্রার ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট জরিপ বা তথ্য না থাকায় কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে। তবে ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তাই এবার তার ব্যাপ্তি জানতে হবে। কোন এলাকায় কী পরিমাণ ইউরেনিয়াম আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য দলটি সরকারের কাছে প্রকল্প চাইবে বলে তিনি জানান। পরমাণু বোমার প্রধান উপকরণ এ ইউরেনিয়াম। এ খনিজ থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ড. ফজলে কিবরিয়া ইলেকট্রো অ্যানালাইসিস পদ্ধতিতে ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি নির্ণয়ের পরীক্ষা করেন। এর আগে ১৯৮০ সালে সিলেটের হারাগোছায় এ মূল্যবান ধাতুটির উপস্থিতি আছে দাবি করা হলেও নির্দিষ্ট করে ঠিক কোথায় এবং কী পরিমাণ ইউরেনিয়াম আছে তা নিয়ে কোনো তথ্য নেই। ড. কিবরিয়া হারাগোছায় গিয়ে পরীক্ষা করে এ তেজস্ক্রিয় পদার্থের নগণ্য উপস্থিতি পান যা প্রায় না থাকার মতোই। তবে এবার কিবরিয়া তার দল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে সিলেট ও মৌলভীবাজারের কয়েকটি স্থানে এ ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন। তিনি আরও নিশ্চিত হতে সংগ্রকৃত নমুনা জাপান ও কোরিয়ায় পাঠান। একই সঙ্গে এ বিষয়ে ভারতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও আলোচনা করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও নমুনা পাঠিয়েছেন। তিনি জানান, ‘গামা স্পেকট্রোস্কপি’ পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে এগুলোয় ইউরেনিয়াম ধরা পড়ে। পরে ‘এনার্জি ডিসপার্সিব এক্স-রে’ পরীক্ষার মাধ্যমে নমুনায় ইউরেনিয়াম নামক সম্ভাব্য মৌল শনাক্ত হয়। তিনি বলেন, এটি দেশের প্রথম চেষ্টা যার মাধ্যমে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার নমুনা সংগৃহীত হয়েছে এবং ঠিক কোন স্থানে কত ঘনত্বের ইউরেনিয়াম আছে তা জিপিএস রেকর্ডে সংরক্ষিত হয়েছে। সাধারণত পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর খনিতে যে ইউরেনিয়াম পাওয়া যায় তার অধিকাংশতেই এর ঘনত্ব ৩০০-১০০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। আর এবার ড. কিবরিয়ার দল যে তেজস্ক্রিয় পেয়েছেন তাতে এর ঘনত্ব ৫৩১ পিপিএম; যা মাঝারি মাত্রার ইউরেনিয়ামের ঘনত্বের সমান। ড. কিবরিয়া এই প্রতিবেদককে আরও বলেন, ‘আমাদের পাঠানো নমুনা ইউরেনিয়ামের সঙ্গে মিলেছে বলে তারা জানিয়েছেন। উপস্থিতি যেহেতু আছে এবার আমাদের ব্যাপ্তি জানতে হবে। কোন এলাকায় কী পরিমাণ ইউরেনিয়াম আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে আমরা অনুদান চেয়েছি। এ ধাপে এসে কাজ ত্বরান্বিত করতে ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি ও জনবল প্রয়োজন হবে। কারণ, ইউরেনিয়াম নিয়ে কাজ করার জন্য আলাদা পরীক্ষাগার প্রয়োজন। এ ছাড়া যেসব যন্ত্রপাতি আছে তা-ও এখন অন্য কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। আর ইউরেনিয়াম নিয়ে কাজ করার জন্য বিশেষজ্ঞ জনবলও তেমন নেই।’ সূত্র জানায়, সিলেট, দিনাজপুর, সুনামগঞ্জ ও সীমান্ত এলাকায় ভারতের যে অংশে মেঘালয় রয়েছে সেখানে ইউরেনিয়ামের সন্ধান মিলেছে। ভারত এরই মধ্যে উত্তোলন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ কারণে ভারতসংলগ্ন বাংলাদেশের এ অংশেও আমাদের ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি যাচাই করা প্রয়োজন। কারণ এ এলাকা থেকে দূরে অবস্থানের পরও সিলেট ও মৌলভীবাজারের ভূগর্ভের মাটির স্তরে এ ধাতুটির উপস্থিতি মিলেছে। আশা করা হচ্ছে, এখানেও বিপুল ইউরেনিয়াম পাওয়া যাবে। ড. কিবরিয়া বলেন, ইউরেনিয়ামের শনাক্তকরণ অনেকটা গ্যাস অনুসন্ধান করার মতো সময়সাপেক্ষ ও জটিল প্রক্রিয়া। তবে যে সম্পদ দেশের জন্য লাভজনক তা উত্তোলনের জন্য সরকারের উচিত সংশ্লিষ্টদের যথাযথ সহায়তা করা। এর আগে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের তত্কালীন সিনিয়র ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি দল হারাগোছায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ইউরেনিয়ামপ্রাপ্তির ব্যাপারে নিশ্চিত করে। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশে ইউরেনিয়াম ব্যবহারে আন্তর্জাতিক অনুমতি না থাকায় এ প্রকল্পের কাজ ওই পর্যন্ত থেমে যায়। ২০০৯ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন পাওয়ার পর এ নিয়ে আবার চিন্তাভাবনা শুরু হয়।

সর্বশেষ খবর