শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চ্যালেঞ্জে বড় দুই দল

বিদ্রোহী নিয়ে টেনশন আওয়ামী লীগে

রফিকুল ইসলাম রনি

চ্যালেঞ্জে বড় দুই দল

সাত বছর পর নৌকা-ধানের শীষের লড়াই হওয়ায় পৌরসভা নির্বাচনকে মর্যাদার সঙ্গে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিজয়ের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। ২৩৪ পৌরসভার মধ্যে কমপক্ষে ৫০টি পৌরসভায় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে। এসব পৌরসভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে বিদ্রোহীরাই শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন।

সূত্রমতে, পৌর নির্বাচনে অনেক এমপি-মন্ত্রী স্থানীয় জেলার শীর্ষ নেতাদের মদদের      থাকা এক প্রভাবশালী কর্মকর্তার প্রার্থী নূর মোহাম্মদ মাসুম বগা তৃতীয় বা চতুর্থ হতে পারেন বলে স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা জানান। একই অবস্থা পাবনার চাটমোহর পৌরসভায়। সেখানে ধানের শীষ প্রতীকে মাঠে থাকা প্রার্থীর চেয়ে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নান জনপ্রিয়তায় অনেকটা এগিয়ে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছাকাছি থাকা ওই কর্মকর্তা পাবনা জেলার মনোনয়নপত্র চূড়ান্ত করেন। এ নিয়ে অনেকটা নিরুপায় ছিলেন কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। জেলা বিএনপির নেতারাও ওই কর্মকর্তার কথায় সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে থাকলেও এ নিয়ে তারা মুখ খুলতে সাহস পান না। পাবনায় তার মনোনীত ধানের শীষ প্রতীক পাওয়া প্রার্থীরা দলের বিদ্রোহী কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীর তুলনায় জনপ্রিয়তায় অনেক কম। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপিতে চাপা উত্তেজনা থাকলেও কেউই মুখ খুলতে সাহস পান না। জেলা বিএনপি নেতারাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তার কারণে বিএনপির ‘ঘাঁটি’ বলে খ্যাত পাবনা জেলা সাংগঠনিকভাবে ‘অকার্যকর’ ভূমিকা পালন করছে বলে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ। জানা যায়, সারা দেশে কোথাও এখনো পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কার করা না হলেও চেয়ারপারসনের প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তার নির্দেশে সম্প্রতি আবদুল মান্নানসহ তিন বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের আপাতত বহিষ্কারের চিন্তা নেই। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চান তাদের নিষ্ক্রিয় করতে। তারপরও জেলা নেতারা বাধ্য হয়ে ওই তিনজনকে বহিষ্কার করেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় সূত্রগুলো জানায়, দলীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে সারা দেশে এখনো পর্যন্ত অন্তত ৩০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে ভোটযুদ্ধে রয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি পৌরসভায় ধানের শীষের চেয়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জনসমর্থনে অনেক এগিয়ে রয়েছেন। ফলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে বিএনপির বিদ্রোহীদের বড় একটি অংশ ‘মেয়র’ হিসেবে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য কয়েকটি পৌরসভায় দলের বিদ্রোহীদের পক্ষে পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও সহযোগিতা করছেন বলে জানা গেছে। গুটিকয়েক পৌরসভায় দলের দুই প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেন বলে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা আশঙ্কা করছেন।

জানা যায়, স্থানীয় সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের কথা রাখতে গিয়ে অনেকটা নিরুপায় হয়েই ওইসব এলাকায় জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়। এ নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও আক্ষেপ রয়েছে। জয়পুরহাটের কালাইয়ে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী আনিসুর রহমান তালুকদার। তিনি জেলা বিএনপির সহসভাপতি। সেখানে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাজ্জাদুর রহমান তালুকদার সোহেল। ওই পৌরসভায় জনপ্রিয়তায় বিদ্রোহী প্রার্থী আনিসুর রহমান তালুকদার অনেকটা এগিয়ে। একই অবস্থা আক্কেলপুরেও। সেখানে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী আলমগীর চৌধুরী বাদশা। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করীম। সুষ্ঠু ভোট হলে বাদশা ও আনিসুর রহমান তালুকদারের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জানা যায়, সাবেক দুই এমপি মোজাহার আলী প্রধান ও ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফার দ্বন্দ্বের কারণে এখনো ওই দুই উপজেলায় দুটি করে কমিটি রয়েছে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী রতন মৃধা। সেখানে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মাহবুবুর রহমান। জনপ্রিয়তায় রতন মৃধা এগিয়ে। সেখানে স্বতন্ত্রপ্রার্থী আবদুল কাদির স্বপন। সেখানে আওয়ামী লীগেরও দুজন প্রার্থী রয়েছেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপির চার প্রার্থীর লড়াইয়ের ফাঁকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী আবদুল কাদির স্বপন বিজয়ী হতে পারেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভায় বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী নজরুল ইসলাম। তিনি ওই পৌরসভার বর্তমান মেয়রও। পৌর বিএনপির এই আহ্বায়কের মনোনয়ন বাতিল হলেও পরে আপিলে প্রার্থিতা ফেরত পান। জনপ্রিয়তায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তোজাম্মেল হকের চেয়ে তিনি অনেকটা এগিয়ে আছেন। সুষ্ঠু ভোট হলে নজরুল মেয়র নির্বাচিত হতে পারেন বলে স্থানীয় লোকজন মনে করছেন। রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভায়ও একই অবস্থা। সেখানে বিদ্রোহীর প্রার্থী পৌর বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল হক। গত নির্বাচনে মাত্র ১৬ ভোটে জামায়াত প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এবার দলের টিকিট না পেলেও স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী তার পক্ষে বলে জানা গেছে। সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মাসুদ রানা তৃতীয় অবস্থানে থাকবেন বলে স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন। তানোর পৌরসভায় বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ফিরোজ সরকার। ওই পৌরসভায় তিনি বর্তমান মেয়রও। দল মনোনীত প্রার্থী মিজানুর রহমানের সঙ্গে লড়াইয়ের ফাঁকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ইমরুল হক বেরিয়ে যেতে পারেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। চারঘাট পৌরসভায় বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী কায়েম উদ্দিন। তিনি বর্তমান পৌর বিএনপির সভাপতিও। সেখানে দল মনোনয়ন দিয়েছে সাবেক মেয়র জাকিরুল ইসলাম বিকুলকে। ফলে সেখানে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নার্গিছ খাতুন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী চান মাহমুদ। জনপ্রিয়তায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ওমর ফারুরের চেয়ে অনেক এগিয়ে তিনি। তার প্রতি কেন্দ্রীয় বিএনপির পরোক্ষ সমর্থনও রয়েছে। মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার শামসুদ্দিনের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। সুষ্ঠু ভোট হলে চান মাহমুদ বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন বলে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা মনে করছেন। একইভাবে ভালকুা বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী মফিজ উদ্দিন। সেখানে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাতেম আলী। আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ডা. মেজবাহ উদ্দিন কাইয়ুম। বিএনপির দুই প্রার্থীর তীব্র লড়াইয়ের ফাঁকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেন বলে স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন। চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ইবরাহিম সওদাগর। সেখানে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তৌহিদুল আলম। বিএনপির এই দুই প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত একক প্রার্থী অধ্যাপক মো. হারুন অর রশীদ বিজয়ী হতে পারেন।

নির্বাচন তদারকিতে খালেদা জিয়া : পৌর নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নিজেই সার্বিক বিষয় তদারকি করছেন।  পৌর নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সব পর্যবেক্ষণ সেলসহ সামগ্রিক বিষয় নিজেই দেখভাল করছেন। কেন্দ্রীয়সহ সাতটি বিভাগে ১৩টি কমিটি ছাড়াও নির্বাচন কমিশন, মিডিয়া, লিগ্যাল এইড ও কূটনৈতিক সংক্রান্ত আরও চারটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব সেলের দায়িত্বে নিয়োজিত নেতারা এলাকায় গিয়ে প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণসহ সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন কি না- তার খোঁজখবর নিচ্ছেন দলীয় প্রধান। এ জন্য প্রতিদিন বিভাগওয়ারি রিপোর্টও নেওয়া হচ্ছে।

প্রচার নিয়ে আজ ২০ দলের বৈঠক : পৌর নির্বাচনে ‘জোটগতভাবে’ প্রচারণায় অংশ নিতে ২০ দলের মহাসচিবদের বৈঠক ডেকেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আজ বেলা ১১টায় রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই বৈঠক ডাকা হয়েছে। দলের সহ-দফতর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পৌর নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এই বৈঠক ডেকেছেন। এর আগে মঙ্গলবার  কেন্দ্রীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সেলের বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নে প্রথমবার স্থানীয় সরকারের  পৌর নির্বাচনে বিএনপি জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে বলে জানান মির্জা ফখরুল। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন হলেও আমরা জোটগতভাবে এই নির্বাচনে মাঠে নামব। জানা যায়, জোটের শরিক এলডিপিকে একটি, জাতীয় পার্টিকে (জাফর) একটি পৌরসভা ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে কয়েকটি পৌরসভা জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।  

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর