শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিএনপির বিদ্রোহীরা বেশি ‘জনপ্রিয়’

শফিউল আলম দোলন ও মাহমুদ আজহার

পাবনা সদর বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নূর মোহাম্মদ মাসুম বগা। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল হাসান মিন্টু। বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া এই নেতা পরপর দুবারের জনপ্রিয় মেয়র। ওই পৌরসভায় চারজন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে এখনো জনপ্রিয়তায় সবার চেয়ে এগিয়ে মিন্টু। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত এই নেতা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছাকাছি কারণেই অনেক বিদ্রোহী প্রার্থীকে বাগে আনা যায়নি। কমপক্ষে ২৫ এমপি বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীদের সহযোগিতা ও মদদ দিচ্ছেন এমন গোপন রিপোর্ট এসেছে দলটির হাইকমান্ডের হাতে। স্থানীয় রাজনীতির হিসাব কষতে গিয়ে ওইসব এমপি দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ না শোনার ভান করে চলেছেন। নিজের অবস্থান সুসংহত করা ছাড়াও ভবিষ্যতের পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে রয়েছেন এসব এমপিরা। গতকালও আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডি অফিস থেকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ এবং কেন্দ্রীয় সদস্য একেএম এনামুল হক শামীম ও এসএম কামাল হোসেন বিভিন্ন জেলায় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। যারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছেন তাদের আলটিমেটামও দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক নেতা নিশ্চিত করেছেন। আওয়ামী লীগের দুর্গখ্যাত শরীয়তপুরের জাজিরা পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ। এ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ইউনুচ বেপারী। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন চারজন। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের ইউনুচ বেপারীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে খায়ের ফকিরের। নড়িয়া পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হায়দার আলী। এখানেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী বাবুল রাঢ়ীর সঙ্গে। বাগেরহাট সদরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান মেয়র খান হাবিবুর রহমান। তাকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনা হাসিবুল হাসান শিপন। স্থানীয় রাজনীতিতে হাবিবুর রহমানের শিষ্য ছিলেন শিপন। পৌর নির্বাচনে গুরু-শিষ্যের লড়াই জমে উঠেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভোটাররা সঠিকভাবে ভোট প্রদান করতে পারলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে দ্বিগুণ ভোটের ব্যবধানে বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করবেন। কুষ্টিয়ার খোকসা পৌরসভায় লড়াই হবে ত্রিমুখী। এ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তরিকুল ইসলাম তারিক। বিএনপির প্রার্থী নাফিজ আহমেদ রাজু। এতে আওয়ামী লীগের দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী। তার মধ্যে শক্তিশালী প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আলম মাসুম মোর্শেদ শান্ত। আলম মাসুম মোর্শেদ শান্ত বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া তারিক বিগত ইউনিয়ন নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি পৌরসভার ভোটারও ছিলেন না। তিন মাস আগে ভোটার হয়েছেন। পৌরবাসী আমার পক্ষেই রায় দেবেন। গোপালগঞ্জ সদর পৌরসভা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কাজী লিয়াকত আলী লেকু। তাকে চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচনে লড়ছেন বিদ্রোহী প্রার্থী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মুশফিকুর রহমান লিটন। লিটন জানান, শহরবাসীর প্রত্যাশা ছিল গোপালগঞ্জ শহর থেকেই দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। কিন্তু তা না করে অন্য এক উপজেলার মানুষকে প্রার্থী করায় শহরবাসীর প্রত্যাশা পূরণে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। তিনি অভিযোগ করেন, আমার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী আমাকে প্রচারে বাধা সৃষ্টি করছেন। ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর আমার নির্বাচনী পথসভায় কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করেছে লেকু ও তার দলবল। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ঘটনায় বহুল আলোচিত পৌরসভা মাদারীপুরের কালকিনি। এ পৌরসভায় মনোনয়ন পান বর্তমান মেয়র এনায়েত হোসেন হাওলাদার। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ গণপদত্যাগ করে। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে তা তুলে নেন। জানা গেছে, এ সংসদীয় এলাকায় আগে এমপি ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাকে দল ও সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দশম সংসদে সেখানে মনোনয়ন পান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। এনায়েত হোসেন হাওলাদার কালকিনির আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাহাউদ্দিন নাছিমের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। এ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী মশিউর রহমান সবুজ। তিনি কালকিনিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। চুয়াডাঙ্গা সদরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দার টোটন। তিনি স্থানীয় এমপি ও হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দার ছেলুনের ভাই। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুর রহমান চৌধুরী। টোটনের চেয়ে জনপ্রিয়তায় বিদ্রোহী প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। চুয়াডাঙ্গার দলীয় জীবননগরে আওয়ামী লীগ নেতা নাসির উদ্দিন। বিদ্রোহী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জেও আওয়ামী লীগের বিজয়ে গলার কাঁটা আওয়ামী লীগ। জেলার করিমগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কামরুল ইসলাম চৌধুরী মামুন। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে শক্তিশালী অবস্থানে আবদুল কাইয়ুম। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর পাল্লাই ভারী। জেলার বাজিতপুরেও একই অবস্থা। এ পৌরসভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনোয়ার হোসেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হলেন আওয়ামী লীগ নেতা সৈকত আকবর।  সুনামগঞ্জের ছাতকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল কালাম চৌধুরী। তার সঙ্গে সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের বনিবনা নেই। এ কারণে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক মেয়র আবদুল ওয়াহিদ মজনুকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন দিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থীর মাথায় এমপির আশীর্বাদ থাকায় নির্বাচনে ধরাশায়ী হতে পারে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বরগুনা সদরে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ। এ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগেরই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। দুজন বিদ্রোহী প্রার্থীই শক্তিশালী। তার একজন হলেন বর্তমান মেয়র শাহাদাত হোসেন ও সাবেক দুবারের মেয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শাজাহান। বর্তমান মেয়র শাহাদাত হোসেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এমপির আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মো. শাহনেওয়াজ শাহেনশাহ। এ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান মেয়র শেখ নুরুন্নবী অপু। তিনি জামালপুর-১ আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদের ভাতিজা। অপুর সমর্থকরা বলছেন, এমপি অনেকটা গোপনে শেখ নুরুন্নবী অপুকে সমর্থন করছেন। যে কারণে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই। একই অবস্থা ইসলামপুর পৌরসভায়ও। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আবদুল কাদের শেখ। এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাজেদ মোশাররফ সেবক। মূল ভোটযুদ্ধ এই দুই প্রার্থীর মধ্যেই হবে। শেরপুর নালিতাবাড়ীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক। বিদ্রোহী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হালিম উকিল। দলের প্রার্থীর চেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর অবস্থান বেশ শক্তিশালী বলে পৌরবাসী মনে করছেন। জেলার নকলা পৌরসভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমনা লিটন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এ পৌরসভায় বিদ্রোহী হিসেবে ভোটারদের মাঝে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী উত্পল। শেরপুরের দুই পৌরসভাতেই বিদ্রোহী প্রার্থীরা শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জুয়েল সরকার। তাকে চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচনী মাঠে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন বর্তমান মেয়র এবিএম আনিসুজ্জামান। পৌরসভার আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে রয়েছেন। জনপ্রিয়তায় আনিসুজ্জামানই এগিয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে। জেলার ফুলপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শশধর সেন। এ পৌরসভাতেও বর্তমান মেয়রকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ফলে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন বর্তমান মেয়র শাহজাহান। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শাহজাহানের সঙ্গেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।

সর্বশেষ খবর