বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিদ্যুতে লুটপাট থামছেই না

সাঈদুর রহমান রিমন

বিদ্যুতে লুটপাট থামছেই না

রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট থামছেই না। প্রতি বছর হরিলুট চলছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। সরকারি তথ্যানুযায়ী, পাঁচটি বিতরণকারী সংস্থায় সিস্টেম লসের হার ১৫ শতাংশ। বছরে এ সিস্টেম লসের কারণে রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে অন্তত ১৮০০ কোটি টাকা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, টেকনিক্যাল কারণে সিস্টেম লসের হার সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। সে হিসাবে বাকি ৮ শতাংশই ঘটে চুরি। প্রতি বছর এ বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ চুরিকে ‘সিস্টেম লসের’ নাম দিয়ে সরকারিভাবেই বৈধতা দেওয়া রয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, কিন্তু সিস্টেম লসের নামে বিদ্যুতে চুরির যে মচ্ছব চলছে তা নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ থাকছে নির্বিকার।

বিদ্যুৎ চুরি রোধে মাঝেমধ্যে ভিজিলেন্স টিম গঠন করে অবৈধ সংযোগ খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, মাঠঘাট চষে বেড়ান ভ্রাম্যমাণ আদালত। নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আশ্রয়, মাসের পর মাস বিদ্যুতের বিল বকেয়া ফেলে রাখা, মিটার টেম্পারিং, অবৈধ সংযোগ স্থাপনের মতো অভিযোগে খুদে গ্রাহকদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। পিডিবি, ডেসকো ও ডিপিডিসির রেকর্ডপত্রে খোদ রাজধানীতেই বিদ্যুতের প্রায় ১০ হাজার গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর কোথাও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগবিহীন কোনো বাড়িঘর, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। দাফতরিক খাতাপত্র আর বিশেষ বিশেষ অভিযানের লগবুকে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ ‘বিচ্ছিন্নকরণ’-এর তালিকা তৈরি হলেও বাস্তবে বিকল্প ব্যবস্থায় সংযোগ বহাল রাখা হয়। এসব স্থাপনা থেকে মাসে মাসে বিলের টাকা তুলে নেন মিটার  রিডাররা। ‘সংযোগ বিচ্ছিন্ন’ তালিকায় থাকায় শুধু সরকার অর্থ পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকে। বিদ্যুৎ খাতে এমন চুরির বাইরেও আছে নানা ধরনের কারসাজি আর হরিলুটের কাহিনী। সর্বগ্রাসী চুরি সর্বত্র : সারা দেশেই বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ বেড়ে গেছে। শিল্প কারখানায় বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে অবৈধ সংযোগের জন্য বিদ্যুৎ অফিসে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ডিপিডিসি (ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) সূত্রমতে, শুধু ঢাকা শহরে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অবৈধভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। ফুটপাথ ঘিরেও অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার বেড়েছে। নগরীর ফুটপাথগুলোর বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহে সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর কাছে অলিখিত লিজ দেওয়া হয়েছে। দোকানপ্রতি ৩০০ টাকা পর্যন্ত সংগ্রহ করলেও বিদ্যুৎ অফিসে জমা দেওয়া হয় ২০ থেকে ৩০ টাকা। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক চুল্লি বা হিটারের ব্যবহার শুধু রাজধানীতে নয়, ইদানীং গ্রামগঞ্জে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। মিটার রিডারদের সঙ্গে কারসাজি করে বৈদ্যুতিক চুল্লির জন্য মাসিক একটি বিল দেওয়া হয়; যার পুরোটা যায় রিডারদের পকেটে। এখন শুধু রান্নাবান্নার কাজেই বৈদ্যুতিক চুল্লি ব্যবহূত হয় না, কাপড়-চোপড় শুকানোর জন্যও ঘণ্টার পর ঘণ্টা এগুলো জ্বালিয়ে রাখা হয়। চুরির নানা কৌশল : পুরান ঢাকার অনেক মহল্লায় মধ্যরাতে ঘড়ি ধরে লোডশেডিং হয়। কিন্তু জেনারেটর লাইনের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে বিদ্যুৎ চুরির মচ্ছব চলে। এর সঙ্গে জড়িত বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা বিদ্যুতের প্রধান সংযোগের সঙ্গে অতিরিক্ত একটি তার লাগিয়ে দিনের পর দিন বিদ্যুৎ চুরি করছেন। এ ছাড়া দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনের কোথাও কোথাও বিকল্প কানেকশনের কারণে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ন্যাশনাল গ্রিড থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত ন্যাশনাল গ্রিডের আশপাশে কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ অনৈতিক কাজে জড়িত। অটো বাইক চার্জ : ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক-অটোরিকশার প্রাদুর্ভাব এখন সারা দেশে। এগুলো চার্জের জন্য বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়। এ ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফোর ফোরটি লাইনের ১১ কেভি থেকে সরাসরি বিকল্প লাইনে ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ নিয়ে ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয়। ফলে বিল দিতে হচ্ছে না। ৩৫০ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এ চার্জে খরচ হয় বলে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা দাবি করেন। বৈদ্যুতিক তার-ট্রান্সফরমার চুরি : বিদ্যুৎ চুরি করেই থামছে না সংঘবদ্ধ চোরচক্র, তারা সরঞ্জামাদি পর্যন্ত লুট করছে। শত শত মিটার তার চুরি করে তা পুড়িয়ে তামা বের করা হয়। আর ট্রান্সফরমার চুরি করে তা আবার বিদ্যুৎ বিভাগেই সাপ্লাই দিচ্ছে আরেকদল চোর। বাসাবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে বৈদ্যুতিক ডিজিটাল মিটার পর্যন্ত চুরি হচ্ছে যখনতখন। সরঞ্জামাদি চুরির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীরা সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ বৈদ্যুতিক লাইন চালু থাকাবস্থায় তার-ট্রান্সফরমার চুরি করতে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন। তা ছাড়া গ্রাম পর্যায় থেকে এসব চুরি করতে হলেও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীদের সহযোগিতা দরকার হয়। বিদ্যুৎ কর্মচারীদের উপস্থিতি থাকলে সাধারণ মানুষ কোনো সন্দেহ করে না। তারা ভাবে, হয়তো লাইন মেরামতের কাজ করতেই ট্রান্সফরমার খুলে নেওয়া হচ্ছে। জানা যায়, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায় পৃথক চোর সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারাই সারা দেশে বৈদ্যুতিক তার, ট্রান্সফরমারসহ সরঞ্জামাদি চুরি করে। টঙ্গী, ভোগড়া, জুরাইন, জিঞ্জিরার ফ্যান কারখানায় বিপুল পরিমাণ তামার তার সরবরাহে তত্পর চোর সিন্ডিকেট। ফ্যানের কয়েলে এ তামার তারের প্রয়োজন। অন্যদিকে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ এবং বিভিন্ন শিল্প ইউনিটে আন্তসংযোগ দিতে লাগে পৃথক ট্রান্সফরমার, যা আমদানি করতে বেশি টাকা খরচ হয়। কিন্তু চোরদের কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকায়ই তা পাওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর