বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

তলে তলে নৌকার সঙ্গে জামায়াত বিদ্রোহের অনলে বিএনপি

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

তলে তলে নৌকার সঙ্গে জামায়াত বিদ্রোহের অনলে বিএনপি

নরসিংদীর মনোহরদী পৌরসভার নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই এখানে ভোটারদের উৎসাহ বেড়েই চলছে। এখন উৎসবের শহরে পরিণত হয়েছে নরসিংদীর সবচেয়ে ছোট এই পৌরসভা। পৌর এলাকার অলি-গলিতে শুধু পোস্টার আর পোস্টার। মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা পৌর এলাকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন। তবে এখানে নির্বাচনী উত্তাপের রয়েছে ভিন্নতা। কারণ এখানে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভোট চাচ্ছেন ধানের শীষের জন্য নয়; জগ প্রতীকের পক্ষে। উপজেলা ও পৌর বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ সব অঙ্গসংগঠনের পদ-পদবির নেতারা দলীয় প্রতীক ধানের শীষের পক্ষে কাজ না করে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল খালেকের জগ প্রতীকের পক্ষে কাজ করছেন। আর এ যেন ঘরের শত্রু বিভীষণ হওয়া। এতে বেকায়দায় বিএনপি সমর্থিত ধানের শীষের প্রার্থী মাহমুদুল   হক। অপরদিকে বিএনপির প্রার্থীর প্রচারণায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের বাধার সম্মুখীন হলেও জামায়াতের প্রচারণায় নেই কোনো বাধা। শুধু তাই নয়, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীকেও নির্বাচনী কার্যক্রমে কোনো ধরনের বাধা দিচ্ছেন না বলে জানায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। আর এতে ২০ দলের জোটের শরিক জামায়াত ও নিজ দলের বিদ্রোহের অনলে পুড়ছেন মাহমুদুল হক। সাবেক এমপি সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল বলেন, জামায়াত বা বিএনপি নামধারী বিদ্রোহী প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যক্রমে কোনো ধরনের বাধা না এলেও আমাদের ধানের শীষের প্রচারণায় হামলা, হুমকি চলছেই। অপরদিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত একজন প্রার্থী থাকলেও মনোনয়ন প্রত্যাশী ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের এখনো নির্বাচনী কোনো কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে দেখা যায়নি। রাগ-গোসা করে অনেক নেতাই এখন নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। আবার কেউ কেউ বলছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নিজে এসে যদি একবার বলতেন তাহলে হয়তো এই অভিমান থাকত না। আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুজন এবং দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সমন্বয়হীনতার কারণে তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মী এখনো সিদ্ধান্তহীন। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুজন বলছেন আমার পক্ষে সবাই আছেন। অপরদিকে জামায়াতের প্রার্থী থাকলেও নিজেরা কোথায় ভোট দেবেন এমন অনিশ্চয়তায় রয়েছে বলে জানা গেছে। কারণ হিসেবে জামায়াতের এক নেতা বলেন, নৌকা ঠেকাতে ভোট দিতে হবে ধানের শীষে, কিন্তু জামায়াতের নারিকেল গাছ প্রতীকে ভোট দিলে ফলাফল ভিন্ন হয়ে যাবে এমন ভাবনায় অস্থির জামায়াত নেতা-কর্মী। তবে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন আচরণবিধি লঙ্ঘন করে দলের প্রার্থী সুজনের পক্ষে বিভিন্ন কৌশলে ভোট চাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে এমপি হুমায়ুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি আমার সংসদীয় এলাকায় জানাজায়ও যেতে পারব না। এটা কী করে হয়। আমি রবিবার কলেজ মাঠে একটি জানাজায় অংশ নিয়েছি। আর এটিকে যদি আচরণবিধি লঙ্ঘন বলে তো কিছু করার নেই। তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম সরকার বাবুল অভিযোগ করে বলেন, এমপি নিজেই এলাকায় এলাকায় গিয়ে ভোটারদের কাছে নৌকার পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। অপরদিকে উপজেলা ও পৌর বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের বর্তমান নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী খালেকের পক্ষে থাকলেও রাতের আঁধারে সাবেক এমপি সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার গুঞ্জন রয়েছে। এদিকে মনোহরদী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ. সামাদ মোল্লা যাদু তিন-তিনবার মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে এখন ঘরমুখো হয়েছেন। বর্তমান মেয়র মো. আলফাজ উদ্দিন, মনোহরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার কবির, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি কফিল উদ্দিন মনোনয়ন না পেয়ে এখন চুপিসারে আছেন। তবে আ. সামাদ মোল্লা যাদু বলেন, অনেকবার মনোনয়ন চেয়েছি, পাইনি। আর কোনো দিন নির্বাচনের চিন্তাই করব না। অপরদিকে পৌর এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার অধ্যাপক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, পৌর এলাকায় ৯০ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তারা সবাই এখন মাঠে নৌকার পক্ষে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আমিনুর রশিদ সুজন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব শুধু মিডিয়ার কাছে, মাঠে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বর্তমানে তরুণদের জয়জয়কার অবস্থা। সেখানে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব। নেত্রী সব ক্ষেত্রেই তরুণদের প্রাধান্য দিয়েছেন। গতকাল মনোহরদী এলাকায় দিনভর ঘুরে দেখা গেছে, আমিনুর রশিদ সুজন বিকালে মনোহরদী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মাঠে উপজেলা ও পৌর এলাকার সব তরুণ আওয়ামী কর্মীদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। পরে পৌর এলাকার ২, ৫ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন। সন্ধ্যার দিকে হাররদিয়া এলাকায় একটি উঠান বৈঠক করেন। অপরদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মাহমুদুল হক সকালে হাররদিয়ায় গণসংযোগ করেন। বিএনপির বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল খালেক মিয়া বিকালে বাসস্ট্যান্ড, বাজারের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন এবং বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি পথসভায় অংশ নেন। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম সরকার বাবুল মনোহরদীর হিন্দুপাড়া ও বাজারের একটি অংশে গণসংযোগ করেন। জামায়াতের প্রার্থী নারিকেল গাছ প্রতীকের অধ্যাপক আমজাদ হোসেন ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। ইসলামী শাসনতন্ত্রের আবদুল মান্নানের পাখা প্রতীকের শুধু পোস্টার দেখা গেলেও প্রচারণা তেমন নেই। সল্লাবাইদ গ্রামের বিধবা হাফিজা বেগম বলেন, ‘ভোট দিয়া কী অইব। আমার কোনো সন্তান নাই। একটা কার্ডের জন্য কতবার গেলাম, পাইলাম না।’ মনোহরদী বাজারের চা দোকানি এমরান জানান, বিএনপি-জামায়াত ত্রিমুখী। আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব। আমরা কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না। জানা গেছে, মনোহরদী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ তোফাজ্জল হোসেন ভূইয়া শাজাহান, উপজেলা যুবদলের সভাপতি সফিকুল ইসলাম মিল্টন, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বিপ্লব, পৌর বিএনপির আহ্বায়ক বদরুল ইসলাম বাবুল, সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন, পৌর ছাত্রদলের (একাংশ) আহ্বায়ক আকরাম হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল কবিরসহ শ্রমিক দল, মহিলা দলের অনেক নেতা-কর্মী বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী জগ প্রতীকের আবদুল খালেকের পক্ষে গণসংযোগ করেন। অপরদিকে ধানের শীষের প্রার্থী মাহমুদুল হকের পক্ষে মনোহরদী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন কাজল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আমিনুর রহমান দোলন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আহসান কল্লোল, মনোহরদী কলেজের সাবেক ভিপি গোলাম মোস্তফা, পৌর যুবদলের সাবেক সভাপতি মোফাজ্জল হোসেনসহ অনেক নেতা-কর্মী কাজ করছেন। মাহমুদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ধানের শীষের কর্মীদের দেখলেই মারধর করে নৌকার সমর্থকরা। ১০ ডিসেম্বর রাতে ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাদের গণসংযোগে হামলা চালিয়ে একটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এমনকি মঙ্গলবার সকালে চকমাধবদীতে গণসংযোগের সময় কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এদের হামলায় আমরা ঠিকমতো নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে পারছি না। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল খালেক বলেন ভিন্নকথা, আমাদের নৌকার পক্ষের কোনো নেতা-কর্মী কিছু বলে না। বরং ধানের শীষের লোকজন নানা জাগায় বাধা দিচ্ছে। জামায়াতের প্রার্থী আমজাদ হোসেন বলেন, নির্বাচনী কার্যকম সুষ্ঠু পরিবেশেই চলছে। মনোহরদীর সাবেক এমপি বিএনপি নেতা সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নেত্রীর মনোনীত ধানের শীষের পক্ষে আছি, থাকব। আজ যারা নিজেদের বিএনপি বলে বেড়াচ্ছেন, তারা বিএনপি না আমরা বিএনপি এটা দেশবাসীই ভালো জানেন। অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এমপি বলেন, প্রথমদিকে হয়তো দলীয় অনেক নেতা নৌকার পক্ষে কাজ করেননি। এখন সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে আছেন। তিনি বলেন, ধানের শীষের পক্ষের বকুল যখন এমপি ছিলেন তখন এলাকায় অনেক অত্যাচার করেছেন। আজ বলছেন অন্য কথা। উনার ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতার কারণে নিজ দলের কর্মীদের হামলার শিকার হচ্ছেন। এদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমিনুর রশিদ সুজন উপজেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে আছেন। তার বাবা একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। বিএনপির প্রার্থী মাহমুদুল হক মনোহরদী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা যুবদলের সভাপতি। মনোহরদী কলেজের সাবেক ভিপি, জিএস। বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল খালেক মনোহরদী উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও পৌরসভার প্রথম মেয়র। জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল উপজেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম সম্পাদক। জামায়াতের প্রার্থী অধ্যাপক আমজাদ হোসেন উপজেলা জামায়াতের রোকন ও হাতিরদিয়া কলেজের সাবেক অধ্যাপক।

এদিকে মনোহরদী পৌর নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বেগম নাসরিন সুলতানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন ও হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ৬ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৌরসভায় মোট ভোটার ১২ হাজার ৭০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬ হাজার ৫১৩ ও মহিলা ৫ হাজার ৫৫৭ ভোটার। মেয়র পদে ৬ জন এবং ৯ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ৩৫ জন। সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ১২ জন। এর মধ্যে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর প্রার্থী মারা যাওয়ায় নির্বাচন স্থগিত রয়েছে।

জামায়াতের প্রার্থী অধ্যাপক আমজাদ হোসেন নৌকার সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমিনুর রশিদ সুজনও অভিযোগটি মানতে নারাজ।

সর্বশেষ খবর