বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দখলে রাজধানীর ফুটপাথ

নেপথ্যে রাজনৈতিক নেতা, ক্যাডার ও বড় ভাইয়েরা, অসহায় সিটি করপোরেশন

লাকমিনা জেসমিন সোমা

দখলে রাজধানীর ফুটপাথ

দখল হয়ে গেছে রাজধানীর বেশির ভাগ ফুটপাথ। এই দখলবাজির জন্য হকারদের দায়ী করা হলেও মূলত পুরো অপকর্মটি নিয়ন্ত্রণ করছেন রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। সরকারি রাস্তার ওপর বসা ভাসমান দোকানপাট ও হকারদের বসিয়ে তাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বিনা পুঁজিতে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন তারা। এই প্রভাবশালী চাঁদাবাজদের তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে রয়েছেন বিভিন্ন স্থানীয় ক্যাডার ও বড়ভাইয়েরা। আর সে কারণেই বার বার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও কূলকিনারা পাচ্ছে না সিটি করপোরেশন। এতে একদিকে যেমন নগরবাসীর দুর্ভোগ বাড়ছে, অন্যদিকে বিপাকে পড়ছেন উচ্ছেদ অভিযানসংশ্লিষ্টরা।

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি মিলিয়ে মোট ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাথ রয়েছে। এর মধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাথই এখন ভাসমান হকারদের দখলে। এর বাইরে ২ হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের ৫৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার রাস্তায় রয়েছে স্থায়ী হকার মার্কেট।

জানা গেছে, ভাসমান হকার থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের অবৈধ দোকানপাট ও স্থায়ী হকার মার্কেট থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা ওঠানো হয়। প্রথম স্তরে এই চাঁদার টাকা স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডাররা তুললেও ধাপে ধাপে এর ভাগ চলে যায় উপরমহলে। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীনদের দলীয় সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও হকার্স লীগের দলীয় ‘বড়ভাইরা’ই এই চাঁদার সিংহভাগ  পেয়ে থাকেন। ফুটপাথগুলো দখলে রাখার নেপথ্যে তারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ প্রসঙ্গে রবিবার গুলিস্তান গোলাপশাহ মাজার এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘আমি সকালে উচ্ছেদ করি তো বিকালে আবার দখল হয়ে যায়। এর সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে কিছু রাজনৈতিক নামধারী নেতা ও পুলিশের অসাধু কর্মকর্তা জড়িত।’ তিনি বলেন, আমি হকারদের বলেছি, এক পয়সাও কেউ চাঁদা দেবেন না। আমরা হকারদের একটি তালিকা তৈরি করছি, যাদের পরবর্তীতে পুনর্বাসন করা হবে। ফুটপাথ পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিদিন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাসহ যা যা করা দরকার সব করা হবে বলেও জানান মেয়র। এদিকে খোদ সরকারদলীয় একজন মন্ত্রীও সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে ফুটপাথ দখলের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনিও এই দখলের নেপথ্যে রাজনৈতিক নেতাদের হাত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমনকি ঢাকার দুই সিটি মেয়রের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে হয়। যানজট কমাতে হলে ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে হবে। সাহস থাকলে ফুটপাথ উদ্ধারে মাঠে নামুন; আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।’ বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার্স সমিতির একটি জরিপ অনুসারে, নগরীর ফুটপাথের ১৩ ভাগ হকারদের দখলে, ১৫ ভাগ  দোকান মালিকদের দখলে, পাবলিক টয়লেট ও অন্যান্য যাত্রী ছাউনি ৫ শতাংশ এবং রাজনৈতিক দলের অফিস ১ শতাংশ। সব মিলিয়ে ৪৮ শতাংশ দখলে এবং ৫২ শতাংশ উন্মুক্ত রয়েছে। নগরবিদ ও ট্রাফিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফুটপাথ ও রাস্তার ওপরে অবৈধ দোকানপাট বসার কারণে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। এ ছাড়া লোকজন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে না পারায় মূল রাস্তার ওপর চাপ বাড়ছে। ফলে কেবল যানজটই বাড়ছে না, বাড়ছে জীবনের ঝুঁকিও। সরেজমিন রাজধানীর গুলিস্তান, মতিঝিল, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, দৈনিক বাংলা মোড়, মালিবাগ, মৌচাক, রামপুরা, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, পুরান ঢাকা, ফার্মগেট, মহাখালী, মিরপুরের বিভিন্ন সড়ক, মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন সড়ক, গাবতলী, নিউমার্কেট, শাহবাগ, শ্যামলী, কল্যাণপুর, কাকরাইল, গুলশানসহ প্রায় প্রতিটি এলাকায় সড়কের ফুটপাথ দখলের চিত্র দেখা গেছে। ওইসব এলাকায় কেউ কেউ আবার স্থায়ীভাবে দোকানপাট গড়ে তুলেছেন। জানা যায়, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দুই সিটির মেয়র ফুটপাথ উদ্ধারের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী গত জুনে গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, জিরোপয়েন্ট, পল্টন এবং পলাশী থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দির পর্যন্ত এলাকায় দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। একইভাবে মিরপুর-১০, তেজগাঁও, রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায় ব্যাপক অভিযান চালায় উত্তর সিটি করপোরেশন। ফুটপাথ ব্যবসায়ীদের নিজে থেকে সরে যেতে দফায় দফায় আলটিমেটামও দেন দুই মেয়র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এতে তেমন কোনো ফল আসেনি। রবিবার ওইসব এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বুলডোজার দিয়ে সব সরিয়ে ফেলা সত্ত্বেও ফের  দোকানপাট বসিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন অবৈধ দখলদাররা। ফুটপাথ ছাড়াও রাজধানীর বহু স্থানে সড়কের ওপরই দোকানপাট ও অবৈধ পার্কিং গড়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি তেজগাঁওয়ে এমন একটি সড়কের (কারওয়ান বাজার টু সাতরাস্তা) ওপর থেকে প্রায় সাড়ে চারশ অবৈধ দোকানপাটসহ ট্রাকস্ট্যান্ড উঠিয়ে প্রশংসিত হন উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। রবিবারও রাজধানীর গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ফুটপাথে অবৈধ দোকানসহ সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নামেন দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন। এর আগে তিনি নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে বলেছিলেন, সংস্থা থেকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও সেটা স্থায়ী হয় না। দখলবাজরা যাতে আবার দখল করতে না পারে সে জন্য স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। এ জন্য তিনি সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক বলেন, চাইলেই কিন্তু আমরা ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে পারি। কিন্তু হুটহাট করে তা করতে চাই না। কারণ এই ফুটপাথ দখলের পেছনে  যেমন প্রভাবশালীতের হাত রয়েছে, তেমনি খেটেখাওয়া ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও জীবিকা নির্বাহের বিষয় রয়েছে। তাই আস্তে-ধীরে তাদের পুনর্বাসন করে একটি স্থায়ী সমাধানের মাধ্যমে ফুটপাথ দখলমুক্তকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।

সর্বশেষ খবর