শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কাজে বেহালদশা

সাঈদুর রহমান রিমন

বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কাজে বেহালদশা

বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের অব্যবস্থাপনার কারণেই দেশের বিমানবন্দরগুলো ডুবতে বসেছে। সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা, দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে দেশের তিন বিমানবন্দরের গ্রেড উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, গাড়ি ও দক্ষ জনবল ছাড়াই বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ পরিচালনা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। তদুপরি আছে যাত্রী ও বাহকের মালামাল বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে যাত্রীদের লাগেজ গায়েব করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে অহরহ।

এসব কারণে ‘এয়ার কার্গো সিকিউরিটি (এসিসি)-৩’ ও ‘রেগুলেশন এজেন্ট (আরএ)-৩’ সনদ নবায়নের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ গোয়েন্দা টিমের সদস্যরা এ দুটি সনদ পেতে তিনটি শর্ত   বেঁধে দিয়ে বলেছেন, খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। শর্তগুলো হলো : কার্গো কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা জোরদার, নিজস্ব জনবল নিয়োগ ও দক্ষ স্ক্যানিং মেশিন অপারেটর নিয়োগ। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এ তিন শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) সনদ দুটি বাতিল করে দেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সনদ দুটি নবায়ন না হলে বিমান বছরে ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে, অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার কার্গো রপ্তানি। উল্লেখ্য, এসিসি-৩ এবং আরএ-৩ সনদবিহীন কোনো বিমানবন্দর থেকে রপ্তানি করা কোনো পণ্যসামগ্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে গ্রহণ করা হয় না। ফলে গোটা দেশের রপ্তানি খাতের জন্য তা চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে বলেও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি শাহজালাল বিমানবন্দরের মান পর্যবেক্ষণে আসা ব্রিটিশ এভিয়েশনের গোয়েন্দা দল গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের নানা অব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের দক্ষতা নিয়ে এসব প্রশ্ন  তোলেন। দুই সদস্যের দলটি সরেজমিন পর্যবেক্ষণে গিয়ে স্ক্যানিং মেশিন অপারেটরদের কার্যক্রম ও বিভিন্ন বিভাগের নেওয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। গোয়েন্দারা বলেছেন, আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতকরণের দুটি সনদ রক্ষায় শাহজালালের স্ক্যানিং বিভাগে আরও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও শিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নির্দেশনা ও সিলেবাস অনুযায়ী তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ থাকাসহ সনদপত্রধারী দক্ষ স্ক্যানিং অপারেটর নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্ব দেন গোয়েন্দারা।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পরিচালিত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কর্মকাণ্ড খুব কাছে থেকেই পর্যবেক্ষণ করেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা দলের সদস্যরা। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চালানো যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ধরন দেখে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। শুধু কার্গো বিমানে পণ্যসামগ্রী লোড-আনলোডের ক্ষেত্রেই নয়, যাত্রীবাহী বিমানে বহনকৃত যাত্রীদের লাগেজ লোড-আনলোডের ক্ষেত্রেও বিমানের চরম গাফিলতি, অনিয়ম ও লুটপাটের চিত্র দেখতে পান গোয়েন্দারা। সেখানে অদক্ষ কর্মীদের অনৈতিকতার কারণে ২ মিনিটের কাজ করতে হচ্ছে ২ ঘণ্টায়। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মান অনুযায়ী যাত্রীরা লাগেজ এরিয়ায় আসার আগেই মালামাল বেল্টে ওঠে যাওয়ার কথা, কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরে তা কল্পনাও করতে পারেন না যাত্রীরা। এখানে যাত্রীরা ফ্লাইট থেকে নেমে কাস্টমসসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করার পরও লাগেজ এরিয়ায় এসে মালামালের জন্য দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তা ছাড়া প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, যাত্রীদের ব্যাগেজের মুখ খোলা, কাটাছেঁড়া। লাগেজ থেকে অনেক মূল্যবান জিনিস চুরি, লুটপাটের ঘটনাও ঘটছে অহরহ।

ব্রিটিশ টিম জানিয়েছে, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিমানের কার্গো রপ্তানি শাখাকে নিজস্ব জনবলের আওতায় না আনলে বিমানের পক্ষে এসিসি-৩ সনদ নবায়ন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, শাহজালালে স্ক্যানিং মেশিন অপারেটর বলতে কোনো পদ নেই। মূলত নিরাপত্তা অপারেটররাই এসব মেশিন চালান। আর অপারেটিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন নিরাপত্তা সুপারভাইজাররা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের কমপক্ষে ২০ জন নিরাপত্তা অপারেটর আছেন যারা স্ক্যানিং মেশিন অপারেটরের দায়িত্ব পেয়ে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অভিযোগ আছে, ডিউটি রোস্টার তৈরির সময় স্ক্যানিং মেশিন অপারেটরের ডিউটি নিতে হাজার হাজার টাকা ঘুষ দেন নিরাপত্তা অপারেটররা। আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে প্রায়ই এরা লাগেজের মধ্যে থাকা বিদেশি মুদ্রা, সোনার চালান, মাদক ও অবৈধ জিনিসপত্র ছেড়ে দিচ্ছেন।

অন্তহীন সমস্যায় বাধাহীন লুটপাট : বর্তমানে নিখুঁত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করার মতো আধুনিক ব্যবস্থা নেই বিমানের। ইমিগ্রেশন পদ্ধতিও আধুনিক না হওয়ায় যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রানওয়েতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই। অ্যাপ্রোচ লাইটের অবস্থা নাজুক। অর্ধেকই ঠিকমতো জ্বলে না। এয়ারফ্রেইট কার্গো কমপ্লেক্স ও কার্গো ভিলেজ চুরি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্য। পণ্য ছাড়াতে বিভিন্ন ঘাটে ঘুষ দিতে হয়। বাংলাদেশ বিমান, কুরিয়ার সার্ভিস আর কাস্টমসের একটি সিন্ডিকেট এ ঘুষবাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। দীর্ঘদিন ধরেই শাহজালালের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিং বিভাগে চুরি, লুটপাট আর চোরাচালান হচ্ছে। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০০টি ফ্লাইট ওঠানামা করছে এ বিমানবন্দরে। সিভিল এভিয়েশন ও বিমানবন্দরের এ অবস্থা নিয়ে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনস ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত ও হতাশ। তারা বলেছেন, এ ব্যবসায় মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছেন তারা। কিন্তু বিমানবন্দর ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিতে যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।

অতিরিক্ত মালামাল বহনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিমানের কার্গো শাখার একটি সিন্ডিকেট। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত সবাই এই আত্মসাতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। বড় বড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন ফ্লাইটে অতিরিক্ত মালামাল পাঠাচ্ছে এ সিন্ডিকেট। এতে করে একদিকে যেমন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বিমানের নিরাপত্তা, তেমনি কোটি কোটি টাকা হারাচ্ছে সংস্থাটি। এর আগে একাধিকবার অভিযোগ ও প্রমাণ মিললেও সিন্ডিকেটটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি বিমান কর্তৃপক্ষ। কার্গো পণ্য রপ্তানি শাখার অধিকাংশ জনবলই বিমানের নিজস্ব নয়। বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কর্মীরা ঝুঁকিপূর্ণভাবে কার্গো রপ্তানি শাখাটি পরিচালনা করছে। বিমান ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছে এসব জনবলকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। সিভিল এভিয়েশন থেকে নামসর্বস্ব নিরাপত্তা পাস নিয়ে এরা কার্গো কমপ্লেক্সে ঢুকছে, অবলীলায় বিমানবন্দরের যে কোনো স্পর্শকাতর স্থানে চলে যাচ্ছে। এ ধরনের ব্যবস্থাপনাকে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থাগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে থাকে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ইমিগ্রেশন কাউন্টারে শত শত যাত্রী দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। যাত্রীদের ইমিগ্রেশন শেষ করতে প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট এবং লাগেজ পেতে আরও দেড়-দুই ঘণ্টা সময় লাগে। তারা জানান, কয়েকটি কাউন্টার ফাঁকা। কোনো ইমিগ্রেশন অফিসার নেই। যারা কর্মরত রয়েছেন তারাও ততটা দক্ষ নন। অদক্ষ কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত স্ক্যানিং মেশিন ডেস্ক পেরিয়ে যাত্রীদের লাগেজ পেতে চরম বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। বাইরে কার পার্কিংয়ের অবস্থা আরও জটিল। বিমানবন্দরের সামনে ও কার পার্কিংয়ের স্থানে সারা দিন ট্যাক্সি ক্যাব ও দালালদের যানবাহনে ভর্তি থাকে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্র জানায়, মাত্র ৩টি পার্কিং নিয়ে ১৯৮২ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক এ বিমানবন্দর যখন যাত্রা শুরু করে তখন প্রতিদিন গড়ে ৬০টি উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ করত। বর্তমানে পার্কিং সংখ্যা ৩৫টি। বেবিচকের একজন পরিচালক জানান, ৫ বছর পর নতুন রানওয়ে ও টার্মিনাল ব্যবহার উপযোগী হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টির মতো বিমান ওঠানামা করলে সেটি স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলা যায়। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরে পাশাপাশি সময়ে ৪-৫টি ফ্লাইট ওঠানামা করলেই বিমানবন্দরের গোটা ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়।

উন্নয়ন তত্পরতা : এয়ারলাইনস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতি বছর। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৫ সাল নাগাদ এখানে বছরে ৬০ থেকে ৭০ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। ২০১৬ সালে তা ৩৫ হাজার এবং ২০২০ সালে ৫০ হাজার হতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পিকআওয়ারে ঘণ্টায় ঢাকায় বিমান ওঠানামা করবে গড়ে ২৫টি। ২০২০ সালে তা ৩৫ ও ২০২৫ সালে ৪৫টিতে উন্নীত হতে পারে। আগামী ২০ বছরে যাত্রী সংখ্যা তিনগুণ বাড়তে পারে। তাতে বর্তমান সুবিধাদি ও রানওয়ে দিয়েই ২০৩০ সাল পর্যন্ত কোনোভাবেই চালানো সম্ভব হবে না।

সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ইতিমধ্যে একনেক প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে শাহজালালে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির জন্য। পাশাপাশি বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিং কার্যক্রম জয়েন্ট ভেঞ্চারে দেওয়ার ব্যাপারেও নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক কনসালটেন্ট নিয়োগে ইতিমধ্যে আরএফপি (রিকোয়েন্ট ফর প্রপোজাল) আহ্বান করেছে বিমান। আরএফপি নীতিমালা তৈরি, নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া নির্ধারণ, অপারেটিং সিস্টেম তৈরি, দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক, সংশ্লিষ্টদের ট্রেনিং ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের গাইডলাইনও  তৈরি করবে প্রতিষ্ঠানটি। এটা করা হলে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের মানও বাড়বে। ম্যানুয়ালের পরিবর্তে সবকিছু ডিজিটালাইজড হয়ে যাবে। এতে শ্রমিকদের কষ্টও কমে যাবে।

সর্বশেষ খবর