রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

একদিন আরও সত্য বেরিয়ে আসতে পারে

নিজস্ব প্রতিবেদক

একদিন আরও সত্য বেরিয়ে আসতে পারে

খন্দকার মাহবুব

গত এক বছরে হয়ে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, বিচারে যে রায় হয়েছে তা মানুষের তৈরি আদালত থেকে এসেছে। এ রায় মেনে নিতে হবে। তবে হয়তো একদিন আরও সত্য বেরিয়ে আসতে পারে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, এই বিচার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দেওয়া বক্তব্য ও অন্যান্য কারণে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হচ্ছে কিনা। তবে আমি যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চাই। কিন্তু এর নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চাই না। সমর্থনও করি না। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খন্দকার মাহবুব হোসেন এ কথা বলেন। ২২ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে তিনি এই সাক্ষাৎকার দেন। ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ খন্দকার মাহবুব হোসেন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি নেতাদের পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনা করছেন। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাও।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ইদানীং সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, শুনছি, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। আমার কথা হলো, এটি একটি ভালো ও শুভ উদ্যোগ হবে। কারণ পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালে গণহত্যাসহ জঘন্য অপরাধ করেছে। তারা বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ করেছে। তাদের অনুপস্থিতিতেও এই বিচার করা যায়। এই বিচার করলে তা একটি ভালো দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আর সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আমি চিফ প্রসিকিউটর হতেও রাজি আছি। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। আন্তরিক ও হূদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে মামলা পরিচালনা করছি। আদালত ধৈর্য সহকারে দীর্ঘ সময় নিয়ে মামলা শুনছেন। মামলা পরিচালনার খাতিরে আদালতে প্রতিপক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে আমাদের হয়তো কখনো মনোমালিন্য ও মনকষাকষি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তা ওই পর্যন্তই। আদালত থেকে বেরিয়ে আমরা আবার বন্ধু ও ভাই হয়ে যাই। এটাই প্র্যাকটিস। এ বছর তিনটিসহ আপিল বিভাগে ইতিমধ্যে মোট পাঁচটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আসামিদের পরিবার বলছে তারা ন্যায়বিচার পায়নি। এমন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন যখন আপিল বিভাগে আরও ১০টি মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে? জবাবে আসামিপক্ষের এই প্রধান আইনজীবী বলেন, সমাজে যখন একটি অন্যায় বা অপরাধ হয় তা প্রতিকারের জন্য বা বিচারের জন্য আমরা আদালতের কাছেই যাই। কারণ এই প্রতিকার দেওয়ার এখতিয়ার কেবল আদালতেরই আছে। আদালতের চেয়ারে বসেন আমাদের সমাজের মানুষ, এই পৃথিবীর মানুষ। ভিনগ্রহের কেউ নয়। আদালতের চেয়ারে বসে কেউ যখন কোনো আবেদন বা অভিযোগ শোনেন তখন তিনি বার ব্যক্তি থাকেন না, প্রতিষ্ঠান হিসেবেই শোনেন। নিম্ন আদালতের রায়ে কেউ সন্তুষ্ট না হলে প্রতিকারের জন্য উচ্চতর আদালত রয়েছে। উচ্চতর আদালতের বিপরীতে সর্বোচ্চ আদালত রয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় সঠিক না হলেও বা ভুল হলেও কিছু করার থাকে না। গত এক বছরে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায়গুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, মানুষের তৈরি আদালত থেকে এই রায় এসেছে। মেনে নিতে হবে। তবে হয়তো একদিন আরও সত্য বেরিয়ে আসতে পারে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর যেসব মামলা আছে, তাতে আমাদের বিশ্বাস আমাদের তথ্য-উপাত্ত আদালত বিবেচনায় নিলে অভিযুক্তরা খালাস পাবেন। দালাল আইনে গঠিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর থাকার পরেও এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামিদের পক্ষে মামলায় লড়ছেন। বিষয়টি স্ববিরোধী বা পেশাগত নৈতিকতা পরিপন্থি কিনা? খন্দকার মাহবুব বলেন, দালাল আইনে গঠিত ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধু আমাকে চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি সেই দায়িত্ব পালন করেছি। তবে তখনকার বিচারের স্পিরিট আর এখনকার বিচারের স্পিরিট এক নয়। এখন বিচার হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এটি এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহূত হচ্ছে। অনেকে বলছেন, সরকার বা সরকারি দলঘনিষ্ঠ কারও কারও বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের গুরুতর অভিযোগ আছে। কই তাদের তো বিচার হচ্ছে না? কেউ কেউ একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের মুরগি সরবরাহ করেছেন বলে শুনছি, এখন তারাই বিচারের পক্ষে আন্দোলন করছেন? কই তাদের বিরুদ্ধে তো তদন্ত বা বিচার হচ্ছে না? আমি যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের পক্ষে। কিন্তু তার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হলে সেই প্রচেষ্টা সমর্থনযোগ্য নয়। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা যারা অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ করেছে তারাই প্রধান আসামি। যুদ্ধের পর তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১৯৫ জন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বিচারের জন্যই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন প্রণয়ন করে। পরে রাজনৈতিক বা অন্য কারণে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার সেই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেয়। সে কারণে প্রধান আসামিদের মুক্ত করে দেওয়া হলো। তখন যারা সহযোগী ছিল, ফৌজদারি আইন অনুযায়ী প্রধান আসামিকে বাদ দিয়ে সহযোগীদের বিচার করা যায় না। এরপর দীর্ঘদিন পর এই বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ যারা আসামি সেই জামায়াতে ইসলামী বা তাদের নেতারা ছিল আওয়ামী লীগের এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোগী। জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগ এক সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন করেছে। তখন তাদের গায়ে যুদ্ধাপরাধের গন্ধ ছিল না। এরপর জামায়াত যখন রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বিরোধী শিবিরে গেল তখন তাদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলো। তাই জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে বিচারটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিনা? ট্রাইব্যুনালে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য নয়। এই বিচারের জন্য ভিন্ন সাক্ষ্য আইন করা হয়েছে। তাতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কেউ ইচ্ছা করলে শোনা কথার ভিত্তিতে সাক্ষ্য দিতে পারেন, তাও গ্রহণযোগ্য। মনগড়া সাক্ষ্য দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। অনেকের ধারণা, প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সেফহোমে নিয়ে শিখিয়ে আনা হচ্ছে। এখানকার আসামিদের অনেকেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আগে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করল না। ৪০ বছর পর হঠাৎ তারা বড় বড় যুদ্ধাপরাধী হয়ে গেল। এসব কথা বিভিন্নভাবে আসছে। আর আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবীর মামলায় লড়া মানে এই নয় যে, তিনি অপরাধকে সমর্থন করছেন। বরং আইনজীবী শুধু দেখেন, আইন অনুযায়ী আসামির ন্যায়বিচার হচ্ছে কিনা। তৃণমূল পর্যায়ের আসামিদের বিচার প্রসঙ্গে খন্দকার মাহবুব বলেন, ইদানীং দেখা যাচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ের আসামিদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। অথচ এই আসামিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ ছিল না। হঠাৎ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসায় জনমনে প্রশ্ন উঠছে এর সত্যতা নিয়ে। এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নাকি বিচার?

সর্বশেষ খবর