বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অর্থনীতি গেছে ভালো আসছে চ্যালেঞ্জ

ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

রুহুল আমিন রাসেল

অর্থনীতি গেছে ভালো আসছে চ্যালেঞ্জ

দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও জাতিসংঘ উন্নয়ন নীতিমালা কমিটির সদস্য ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করেছে। এ নিয়ে নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যের ভাব বা নির্লিপ্ততা দেখা যাচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কিছু দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলে গণতন্ত্রের ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া যেত। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে স্বতঃস্ফূর্ত  ব্যক্তি-উদ্যোগ বিকাশের জন্য উদার, খোলামেলা আস্থাপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দক্ষ জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থার বিকল্প নেই। আগামী বছর ২০১৬ সালের চ্যালেঞ্জ সেখানেই। গত সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডির নিজ বাস ভবনে বসে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, দুর্বল বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বছর শুরুর রাজনৈতিক অস্থিরতার বিচারে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করেছে। তবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম বছর হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে গতিশীল করার বা প্রবৃদ্ধিকে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে উন্নীত করার মতো যথেষ্ট উদ্যোগ-আয়োজন সম্ভব হয়নি। ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিশ্বব্যাংকের তালিকায় আমরা নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। আর এই বিদায়ী বছরেই নিজস্ব অর্থায়নে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়েছে। যে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক বাতিল করে দিয়েছিল। তবে জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী— স্বল্প আয়ের দেশ বা এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসতে অন্তত আরও ছয় বছর লাগবে। অর্থনীতির এই বিশ্লেষক মনে করেন, বিদায়ী বছরের অর্থনীতির সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো— বিনিয়োগের জন্য আর্থিক মূলধনের জোগান আছে। কিন্তু তা কাজে লাগানোর মতো বিনিয়োগের চাহিদা নেই। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়াতেই তা স্পষ্ট। বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বাড়ছে না বলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অলস অর্থ নিয়ে সমস্যায় আছে। মূল্যস্ফীতির হিসাবে ধরলে, আমানতের সুদের হার ইতিমধ্যে ঋণাত্মক হয়ে গেছে। যা সাধারণ মানুষের সঞ্চয় প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। যে কোনো কারণেই হোক ব্যবসার পরিবেশে আস্থার অভাব আছে। দেশের শাসনব্যবস্থা ও নীতিমালার দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিকতা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সংশয় কাটছে না। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। দেশ থেকে পুঁজি পাচারও অব্যাহত আছে। সব কিছু মিলিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এক ধরনের সাময়িক স্বাচ্ছন্দ্যের ভাব বা নির্লিপ্ততা দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে কিছু বিষয় কাজ করছে। যেমন আপাত দৃষ্টে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসা, সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও বিদেশি মুদ্রার বড় রিজার্ভ। এরসঙ্গে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার ফলে আমদানি ব্যয়ে বড় ধরনের সাশ্রয়। এর অনুকূল প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ও বাজেটের অর্থসংকুলানের ওপর। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুবিধা পুরোটাই পাচ্ছে সরকারের বাজেট, এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত দেশের বাজার মূল্যে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জ্বালানি তেলের দাম কমার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। প্রবৃদ্ধিকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং অর্থনীতির রূপান্তরগত পরিবর্তন আনার জন্য যে ধরনের শক্ত সংস্কারের পদক্ষেপ দরকার, তার তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। যে সব ক্ষেত্রে শক্ত সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেগুলো হলো— আর্থিক খাতের জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, করফাঁকি বা বিদেশে অর্থ পাচার রোধ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা উন্নতি করা বা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গতিশীলতা আনা। এসব ক্ষেত্রে এক ধরনের শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নে গঠিত প্যানেল ইকোনমিস্ট কমিটির এই প্রধান মনে করেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার জন্যে রাজস্ব সংগ্রহ জোরদার করার প্রচেষ্টা এখন থেকেই নেওয়া দরকার। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরির সময় এসব খাতের প্রয়োজনীয় বাড়তি ব্যয় কীভাবে সংগ্রহ করা যায়, তার হিসাব মেলাতে বেশ কষ্ট হয়েছে। এতে রাজস্ব জিডিপির অনুপাত বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী (আবুল মাল আবদুল মুহিত) এ কে বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলেছেন, বলে পত্রিকায় সংবাদ দেখেছি। তবে মনে রাখতে হবে— কর প্রশাসন আমাদের বাজেট ব্যবস্থায় বড় দুর্বল জায়গা। নেপালে রাজস্ব জিডিপির হার ১৮ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ১২ শতাংশে আটকে আছে। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নতি না হয়ে খেলাপি ঋণের বোঝা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে বাজেটের অর্থ দিয়ে এগুলোর মূলধন পুনঃভরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

ইকোনমিক রিচার্স গ্রুপের (ইআরজি) এই চেয়ারম্যানের মতে, অর্থনীতিকে সচল করার জন্য আগামী বছর ২০১৬ সালে আশু করণীয় হলো— বিনিয়োগের পরিবেশ কী করে আরও উন্নত করা যায়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও জমি সমস্যার সমাধান কাজগুলো অবশ্যই জরুরি, তবে ব্যবসার পরিবেশে আস্থা তৈরি করার বিষয়টি আরও ব্যাপক। শেষ বিচারে সমস্যাটিকে দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি থেকে আলাদা করে দেখার অবকাশ নেই। গণতান্ত্রিক সুশাসনের বিষয়ে অগ্রগতি ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কারের কার্যক্রম কেবল একটা পর্যায় পর্যন্তই এগিয়ে নেওয়া যায়। প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদের মতে, স্বাধীনতা পরবর্তী পুরো সময়ে অনেক অর্জন সত্ত্বেও আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো— দেশের শাসনব্যবস্থার বিষয়ে এখনো একটা টেকসই রাজনৈতিক বন্দোবস্তে আসতে পারিনি। আগামী এক বছরে এর সমাধান হবে তা কেউ মনে করে না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে, তার ভিত্তি রচনার কাজ তো শুরু করতে হবে। স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তি-উদ্যোগ আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। আর এই ব্যক্তি-উদ্যোগ বিকাশের জন্য উদার, খোলামেলা আস্থাপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দক্ষ জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থার বিকল্প নেই। ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এ যাবৎকাল কৃষির বাইরে অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প। ক্ষুদ্র উদ্যোগ, বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি, এসব ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি এসেছে অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমশক্তি ও নিম্ন প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। প্রবৃদ্ধির পরবর্তী ধাপে যেতে হলে প্রয়োজন হবে— প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও আরও দক্ষ জনশক্তি।

ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, ভবিষ্যতের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো— নগরায়ণ ও শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। বিগত কয়েক দশকে ঢাকা নগরী একটি প্রাদেশিক শহর থেকে জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীর ১০টি বৃহত্তম মহানগরীর একটি হয়েছে। একদিকে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির বড় অংশই আসে ঢাকা নগরীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। অন্যদিকে এটি বিশ্বের বসবাস অযোগ্য নগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের মতো, নিম্ন আয়ের দেশে এত বড় নগরীর নাগরিক চাহিদা মেটানোর চ্যালেঞ্জটি কতটা কঠিন, তা এ থেকেই বোঝা যায়। এ কারণেই নগরায়ণের বিকেন্দ্রিকরণ জরুরি।

সর্বশেষ খবর