বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বছরজুড়েই কোণঠাসা ছিল বিএনপি

মাহমুদ আজহার

২০১৫। বছরজুড়েই ‘কোণঠাসা’ ছিল বিএনপি। জানুয়ারি থেকে টানা তিন মাসের ‘নস্ফিল’ সহিংস আন্দোলনের পর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দলটি। অগোছালোভাবেই বছর শেষ করেছে বিএনপি। প্রথম তিন মাস রাজপথে থাকলেও এরপর বিএনপি না ছিল আন্দোলনে, না করেছে সংগঠন গোছানোর কাজ। অবশ্য পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ছিল বলে দাবি বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের। নভেম্বরে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেও ডিসেম্বরে পৌর নির্বাচনের ডামাডোলে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে বিএনপি। পৌর নির্বাচনকে ঘিরে বছরের শেষদিকে এসে বিএনপি নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক মাঠে থাকতে দেখা যায়। নিষ্ক্রিয় নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, টানা তিন মাসের ‘ব্যর্থ’ আন্দোলনের মাশুল এখনো গুনতে হচ্ছে বিএনপিকে। পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীরা রাজপথমুখী হলেও বছরজুড়ে ছিল আত্মগোপনে। নির্বাচনের পর তারা ফের আড়ালে চলে যেতে পারেন। বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী মামলার আসামি। অনেকেই এখনো কারাগারে। অনেকে আত্মগোপনে, আবার সিনিয়র নেতাদের বড় একটি অংশই নিষ্ক্রিয়। আন্দোলন চলাকালে নাশকতার ঘটনা বিএনপির ভাবমূর্তি সংকটে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিএনপিকে এখনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ অবস্থায় ২০১৬ নতুন বছরের শুরুতে আবার রাজপথের আন্দোলনে যেতে চায় না বিএনপি। পৌর নির্বাচনের পর দলটি সংগঠন পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে চায়। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা পৌরসভা নির্বাচনের পরপরই কাউন্সিল করব। বর্তমান দেশে যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো খুবই দুস্কর হয়ে পড়েছে। বলা চলে, প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এটাকে ব্যর্থ বলা যাবে না। এর মধ্যেও আমরা জেলায় জেলায় সংগঠন গোছানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মূল বিষয়টা হচ্ছে, জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতে সরকার বিএনপির দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। বিদায়ী বছরে বিএনপির উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল— টানা তিন মাসের অবরোধ। গুলশান কার্যালয়ে টানা তিন মাস অবরুদ্ধ ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল সর্বত্রই। এরপর গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে খালেদা জিয়া আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে অবশ্য জামিন নিয়ে বাসায় ফেরেন। আর বছরের নানা সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, দল ভাঙার অপতত্পরতা। যদিও এর উদ্যোক্তারা সফল হননি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোটের দিন নির্বাচন বর্জনও ছিল আলোচনায়। ঢাকায় নির্বাচনী প্রচারে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে একাধিকবার হামলা, দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ, সৌদি আরব সফর বাতিলের পর দুই মাসের লন্ডন সফর নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা আলোচনা হয়। খালেদা জিয়া লন্ডন চলে যাওয়ার পর দল ও রাজনীতি থেকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর বিদায়ও ছিল আলোচনার বিষয়। সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আলোচনা ছিল বিএনপির ভিতরে বাইরে। তবে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করলেও পৌরসভা নির্বাচনের কারণে আপাতত থমকে আছে। জানুয়ারিতে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে বলে বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.), ড. আবদুল মঈন খান ও ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার ফোনালাপ ফাঁস ছিল এ বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। দলের নীতি, আদর্শ ও আন্দোলন নিয়ে তাদের বক্তব্য দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। সর্বশেষ ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ নামে একটি বই পুনঃপ্রকাশ করে ডিসেম্বরে আলোচনা-সমালোচনায় ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ২০১৫ সাল কেমন গেল বিএনপির— এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বছরজুড়েই বিএনপিকে অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। তারপরও দলটির অনেক ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা পুরোপুরিভাবে সে বিচক্ষণতা দেখাতে পারেনি। বিএনপিকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করতে হয়েছে। অনেক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছে। তবে বিদায়ী বছরে যা ভুলত্রুটি হয়েছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে বিএনপিকে শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অবশ্য বড় দলগুলোকে এ ধরনের চ্যালেঞ্জে নানা কারণে পড়তে হয়। সেখান থেকেও তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। যে কোনো কারণেই হোক না কেন, বছরজুড়েই বিএনপি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে। এ দুর্বলতা কাটিয়ে বিএনপিকে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পথে ফিরে যেতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুলের মতে, ‘২০১৫ সাল শুধু বিএনপির জন্যই নয়, গোটা রাজনীতির জন্য খারাপ বছর গেছে। বিএনপির নেতৃত্ব কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ব্যর্থতার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক সিদ্ধান্তও নিয়েছে দলটি। পৌর নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তবে চলতি বছর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুরোপুরিভাবে থমকে ছিল। কোনো রাজনৈতিক শক্তি নয়, দেশ চালিয়েছে প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনী। বাংলাদেশে গতিশীল কোনো বিরোধী দলও ছিল না। তবে এটাও ঠিক, বিএনপি মামলা-হামলাসহ নানাভাবে বিপর্যন্ত ছিল।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘বছরজুড়েই অগোছালো থেকে বিএনপি বেরিয়ে আসতে পারেনি। মামলা-হামলায় তাদের বছর পার হয়েছে। দলের সাংগঠনিক নেতৃত্বেও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি। অবশ্য এ বছরটাই খারাপ ছিল। আশা করেছিলাম, এ বছর অন্তত প্রধান দুই দলের মধ্যে একটি সংলাপ-সমঝোতা হবে। কিন্তু আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। অন্যদিকে সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের কারণে সংসদও ছিল অনেকটাই অকার্যকর।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর