রবিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

ব্যাংক পরিচালক পদে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী নিয়োগ আর নয়

৩০ পরিচালক পদ শূন্য, আগামী সপ্তাহে নিয়োগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিচালক পদে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিয়োগ না দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা চলছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও বেসিক ব্যাংকে একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত পরিচালকদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আগের অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে একরম আভাস পাওয়া গেছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও নতুন এ উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন।

বর্তমান সরকারের পরপর দুই মেয়াদেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতে ‘হল-মার্ক’ ও ‘বিসমিল্লাহ’র মতো বহুল আলোচিত আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে ছোট-বড় অসংখ্য কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। এসব কারণে বর্তমানে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে দলীয় নেতা-কর্মীদের বদলে অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও সাবেক ব্যাংকারদের নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সূত্র জানায়, গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকে ৩০ জন পরিচালকের পদ শূন্য রয়েছে। তিন বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা ও অগ্রণীতে ২১ জন পরিচালকের পদ শূন্য রয়েছে। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে (বিডিবিএল) ৯ পরিচালকের পদ শূন্য। এসব ব্যাংকের শূন্য পদে শিগগিরই পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হবে। মহাজোট সরকার ২০০৯ সাল থেকেই রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ দিচ্ছে। এসব নিয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা হচ্ছিল। অর্থমন্ত্রী বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, ব্যাংকের পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনায় আগে অনেক নিয়োগ দিয়েছি। এবার নিয়োগ দেব সাবেক আমলা ও সাবেক ব্যাংকারদের। নতুন নিয়োগে দেরি হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার কাছে একটা তালিকা আছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। আগামী সপ্তাহে হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমলা ও ব্যাংকাররা একটা গণ্ডির মধ্যে থাকেন। শুধু এই দুই পেশা থেকেই পরিচালক নিতে হবে, তা জরুরি নয়। শিক্ষক, ভালো ব্যবসায়ী বা অন্য পেশাজীবীদের কথাও ভাবা যায়। সুশাসনের জন্য ভালো পরিচালকের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনারও উন্নয়ন জরুরি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল জারি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অর্থনীতিবিদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, ব্যবসায়ী এবং কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবীকে ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য করা হবে। কিন্তু গত ছয় বছরে তা মানা হয়নি, বরং সমাজসেবক আখ্যা দিয়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে পর্ষদ সদস্য বানানো হয়েছে। এদিকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের কার্যক্রমেও বিধি-নিষেধ আসতে পারে। চেয়ারম্যানের জন্য সুসজ্জিত কক্ষ থাকা; এমডির মতো চেয়ারম্যানদের অফিস করা; পর্ষদ বৈঠক ছাড়া পরিচালকদের নিয়মিত ব্যাংকে আসা-যাওয়াও ঠেকাতে অর্থ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। গত ছয় বছরে সোনালী ব্যাংকে কাজী বাহারুল ইসলাম, অগ্রণী ব্যাংকে খন্দকার বজলুল হক, জনতা ব্যাংকে আবুল বারকাত, রূপালী ব্যাংকে আহম্মদ আল কবির, বেসিক ব্যাংকে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকে সাবেক নৌবাহিনী প্রধান এ. তাহের এবং বিডিবিএলে শান্তি নারায়ণ ঘোষ দুবার করে চেয়ারম্যান হন। পরিচালক হন মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী জান্নাত আরা হেনরী, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সুভাষ সিংহ রায়, ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি শাহজাদা মহিউদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাবেক ভিপি কে এম এন মঞ্জুরুল হক, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য খোন্দকার জাহাঙ্গীর কবির প্রমুখ। সোনালী ব্যাংকে ১৩ সদস্যের পর্ষদ থাকার কথা থাকলেও ৭ জনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ১৯ ডিসেম্বর। এখন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) আছেন মাত্র ৪ জন। সোনালী ব্যাংকেরই সাবেক কর্মকর্তা কাজী বাহারুল ইসলামকে দুই দফা চেয়ারম্যান করা হয়। অবশ্য হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর দ্বিতীয় বার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি তিনি। অগ্রণী ব্যাংকে ১২ সদস্যের পর্ষদের ৮ জনেরই মেয়াদ শেষ। তাদের মধ্যে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলরাম পোদ্দার, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহসম্পাদক আবদুস সবুর, রহিমআফরোজ গ্রুপের পরিচালক নিয়াজ রহিম এবং স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা এম এ রউফ সরদার দুবার করে পরিচালক ছিলেন। জনতা ব্যাংকের পর্ষদে শূন্য পদ ছয়টি। আগে এসব পদে দুই দফায় ছিলেন অর্থ বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ইমদাদুল হক, আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য-বিষয়ক সহ-সম্পাদক নাগিবুল ইসলাম দীপু, সাবেক ডিআইজি সৈয়দ বজলুল করিম, সাবেক ব্যাংকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক রমণী মোহন দেবনাথ এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন। বিডিবিএলে শূন্য থাকা পাঁচ পরিচালকের পদে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুস্তম আলী আহমেদ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ এপতার হোসেন পিয়ার, দেওয়ান নুরুল ইসলাম, আইনজীবী আবদুস সালাম ও কাজী মোরশেদ হোসেন কামাল।

সর্বশেষ খবর