শিরোনাম
শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

যে কারণে বিরোধী দল হতে পারেনি জাতীয় পার্টি

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

সরকারের দুই বছরেও বিরোধী দল হিসেবে আস্থা অর্জন করতে পারেনি সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা সরকারের সাজানো বিরোধী দল। জাতীয় পার্টি সরকারে আবদ্ধ। তাই তাদের পক্ষে সত্যিকার অর্থে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। শুধু বিশ্লেষক নয়, জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারাও তাই মনে করেন। ২ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বলেছেন, ‘জনগণ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল মনে করে না। আমি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। সরকারে আমাদের মন্ত্রিত্ব রয়েছে। দেশের জনগণ আমাদের প্রধান বিরোধী দল মনে করে না।’ তিনি জাতীয় পার্টি যেন প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে, সে জন্য সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের প্রতি আবেদন জানান। রওশনকে উদ্দেশ করে এরশাদ বলেন, ‘আপনার কাছে আবেদন, জাতীয় পার্টি যেন প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে।’ এ ছাড়া অতিসম্প্রতি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এইচ এম এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘জাতীয় পার্টি আইনগত এবং বাহ্যিক কোনোভাবেই বিরোধী দল নয়। জাতীয় পার্টির অধিকাংশ সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের দ্বারা নির্বাচিত। জাতীয় পার্টির পক্ষে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন সম্ভব নয়। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাংঘর্ষিক।’ তিনি বলেন, “আমার জানা মতে সংসদে জাতীয় পার্টি একটিও ‘না ভোট’ দেয়নি। তাই বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।” প্রসঙ্গত, পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী। প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী, মশিউর রহমান রাঙ্গা সমবায় প্রতিমন্ত্রী। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টির নেতারা সরকারের বিরোধিতার পরিবর্তে উল্টো সরকারের কাছ থেকে নানান সুবিধা নিতে ব্যস্ত। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করে সৌদি আরব পাঠানো হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে বিরোধী দল হিসেবে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় পার্টি ঘোষণা দিয়েছিল সংসদ বর্জনের রীতি ভাঙার। চিরাচরিত ধারণা পাল্টে নিয়মিত সংসদে যোগ দিয়ে সংসদকে প্রাণবন্ত করার ঘোষণাও ছিল শীর্ষ নেতাদের। এ ছাড়া সংসদে বিএনপির মতো বড় দলের শূন্যতা এড়াতে এবং কার্যকর ও সক্রিয় বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে প্রমাণ করার একটা তাগিদ ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকেও ছিল। পাশাপাশি সরকারের অবস্থান শক্ত রাখতে সংসদে সত্যিকারের আদলে একটা বিরোধী দলের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তাও ছিল বেশি। এ ছাড়া নবম সংসদ পর্যন্ত বিরোধী দলের সংসদ বর্জন যে রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার জন্য জনগণের মধ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের বীতশ্রদ্ধ ভাব তৈরি হওয়ায় সাধারণ মানুষের আস্থা হারায় বিরোধী দল। তাই এ রীতি পাল্টাতে ঘোষণা দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত করতে। শপথের পরই বিরোধীদলীয় নেতা রওশন বলেছিলেন, তারা সংসদে থেকেই সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবেন। কিন্তু গত দুই বছরে রওশনের নেতৃত্বে বিরোধী দল নানান বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করলেও একটিও ‘না ভোট’ দেননি। পার্টির চেয়ারম্যান কার্যত বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকার থেকে দলের মন্ত্রীদের বের হয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তা-ও হয়ে ওঠেনি। মন্ত্রীরা তখন বলেছেন, আগে পার্টির চেয়ারম্যানকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ ছাড়তে হবে। তবে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ ৫ জানুয়ারি সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৫ সালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, বিরোধী দলের ভূমিকা সক্রিয় করার জন্য জাতীয় পার্টি মন্ত্রিপরিষদ থেকে তাদের বের হয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে। কিন্তু গত এক বছরে এর কোনোই অগ্রগ্রতি নেই। সমালোচকরা বলছেন, মাঠেঘাটে সভা-সেমিনারে সরকারের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিয়ে জাপা নেতারা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিতে ব্যস্ত। কিন্তু জনগণ বোকা নয়। তিন সিটি করপোরেশন, উপজেলা নির্বাচন এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটেছে। এসব নির্বাচনে চরম ভরাডুবি হয়েছে দলটির। এ অবস্থায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি যেন এখন কাঁঠালের আমসত্ত্বা। এটা একটা অলীক জিনিস। জাতীয় পার্টি সরকারি, না বিরোধী দল— এ নিয়ে যে প্রশ্ন তা-ও তো এখনো খোলাসা করতে পারেনি। বিরোধী দলের ভূমিকা হলো সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা, জবাবদিহিতা ও পরস্পরের প্রতি নজরদারির কাঠামো নিশ্চিত করা; যাতে কেউ কোনো ধরনের অপকর্ম, অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে না পারে। কিন্তু জাতীয় পার্টি নিজেই তো সরকারের অংশ। কে কাকে দেখবে?’

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা সাজানো বিরোধী দল। তাদের কাজ আর কী হবে? সরকারই তাদের চালায়। যা করে তা সরকারের সাজানো। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।’

এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। কারণ সরকারে আমাদের তিনজন মন্ত্রী রয়েছেন। পার্টির চেয়ারম্যান নিজেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। বিরোধী দলে থেকেও মন্ত্রিত্ব নিয়ে সত্যিকার অর্থে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। তবে জাতীয় সংসদে আমরা ভূমিকা পালন করছি।’

সর্বশেষ খবর