বৃহস্পতিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
বিপাকে বিটিআরসি, দফায় দফায় নোটিস

সাইবারক্যাফের আড়ালে ভয়ঙ্কর অপরাধ

লাকমিনা জেসমিন সোমা

রাজধানীজুড়ে বেড়ে গেছে অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসা। বিশেষ করে অলিগলিতে থাকা লাইসেন্সবিহীন সাইবারক্যাফের আড়ালে চলছে ইন্টারনেটভিত্তিক নানা অপরাধ। এ ধরনের ক্যাফে বন্ধে বার বার আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নোটিস দিয়েও ফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোবাইল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বর্তমানে ইন্টারনেট সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলেও তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ এখনো সাইবারক্যাফের দ্বারস্থ হচ্ছে। সেখানে পর্নোগ্রাফি দেখা বা ডাউনলোড থেকে শুরু করে এরা বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছে। অনেকে সাইবারক্যাফেগুলোয় বসে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে অপতত্পরতা চালাচ্ছে। এ রকম ঘটনায় গত জুনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীর খিলগাঁওয়ে অভিযান চালিয়ে দুই সাইবারক্যাফে মালিককে জেল ও জরিমানাও করেছিলেন। এ ক্যাফেতে অশ্লীল ছবি দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। সরেজমিনে রাজধানীর অনেক সাইবারক্যাফে ঘুরে বিভিন্ন অপরাধের চিত্র পাওয়া গেছে। নিউমার্কেট এলিফ্যান্ট রোডের একটি সাইবারক্যাফেতে গিয়ে দেখা গেছে, স্কুল ইউনিফর্ম পরা সাত-আট জন তরুণ এক কম্পিউটারে বসে ফেসবুক চালাচ্ছে। তারা ‘নীল পরি’ নামে একটি ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে নিজের ক্লাসের এক বন্ধুকেই নিয়মিত বিরক্ত করছে। মিরপুরের শ্যাওড়াপাড়ায় ছোট্ট একটি ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, একটিমাত্র কম্পিউটার দিয়ে চড়া রেটে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হচ্ছে। ‘লাইসেন্স আছে কিনা’— জানতে চাইলে দোকানদার এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘বাবার টাকায় কম্পিউটার কিনে ব্যবসা করছি। লাইসেন্স লাগবে কেন?’ আরও দেখা যায়, মালিবাগ মোড়ের প্রথম লেনে ‘সাইবারক্যাফে’ নাম দিয়ে একটি দোকানে নিবন্ধন ছাড়াই নামমাত্র দামে পুরনো মোবাইল ফোন সিম বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, খিলগাঁও, আজিমপুর, মিরপুর, উত্তরা, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় সাইবারক্যাফের আড়ালে অবৈধভাবে ইন্টারনেট সরবরাহ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, অপরাধীরা অনেক সময় মোবাইলের বদলে এসব ক্যাফে থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ভিওআইপি কল করে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহজে তাদের শনাক্ত করতে পারছে না। এ ছাড়া নিজ বাড়িতে সুযোগ না পেয়ে অনেক ছেলেমেয়েই অশ্লীল বই, ভিডিও, স্থিরচিত্র ও অ্যাডাল্ট লাইভ চ্যাটিংয়ের জন্য বেছে নিচ্ছে সাইবারক্যাফেগুলো। অনেক ক্ষেত্রে এসব দোকানের আড়ালে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিটিআরসির ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে লাইসেন্সধারী বৈধ সাইবারক্যাফে ও ইন্টারনেট সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ১৪৫টি। কিন্তু সাইবারক্যাফে ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিসিওএবি)-এর দেওয়া তথ্যানুসারে, রাজধানীতে বর্তমানে প্রায় ৫০০ সাইবারক্যাফে ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার বা ইন্টারনেট সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭০ ভাগেরই লাইসেন্স নেই। এমনকি ঢাকায় অ্যাসোসিয়েশনের আওতাভুক্ত প্রায় সাড়ে তিনশ সদস্য প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকেরই লাইসেন্স নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অ্যাসোসিয়েশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের সংগঠনের বাইরে ঢাকায় অন্তত ২ হাজার ইন্টারনেট সেবাভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই লাইসেন্স নেই। জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানকে বৈধতা দিতেই সংশ্লিষ্ট মালিক ও ব্যবসায়ীদের বিটিআরসি বার বার লাইসেন্স নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। সাইবারক্যাফে ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এ এম কামাল উদ্দিন আহমদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিটিআরসির ধরপাকড়ের কারণে গত কয়েক মাসে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের বেশির ভাগ সদস্যই লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছেন। তারা খুব শিগগিরই লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসার বৈধতা পাবেন।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সর্বশেষ গেল মাসের ৪ তারিখে ‘অবৈধ সাইবারক্যাফে ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধে’ জরুরি নোটিস জারি করে বিটিআরসি। সেখানে বলা হয়, ‘অবৈধ ইন্টারনেট ও সাইবারক্যাফে পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বার বার অভিযান চালানো হয়েছে। তাদের লাইসেন্স নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যারা অনুরোধ মানছেন না, তাদের এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো।’ জানা যায়, এর আগেও বিটিআরসি গত জুন থেকে কয়েক দফা এ-সংক্রান্ত নোটিস জারি করেছিল।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবসার জন্য বিএসসিসিএল, আইআইজি, আইটিসি, বিডব্লিউএ, এনটিটিএন ও আইএসপি লাইসেন্সধারী বৈধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যান্ডউইথ্ড সরবরাহ করে। অভিযোগ রয়েছে, ব্যান্ডউইথ্ড সরবরাহারী এ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ম ভঙ্গ করে লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ব্যান্ডউইথ্ড সরবরাহ করছে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সতর্ক করেছে বিটিআরসি। গত মাসে দেওয়া বিটিআরসির পরিচালক (লাইসেন্সিং) এম এ তালেব হোসেন স্বাক্ষরিত এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বিটিআরসি লাইসেন্স ছাড়া ইন্টারনেট ও সাইবারক্যাফে সেবাদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি, সেবা প্রদান, সেবা গ্রহণ ও ব্যান্ডউইথ্ড দেওয়া থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়। বিটিআরসি এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রমে সহায়তার দায়ে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেয়।

বিটিআরসির লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্স বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লাইসেন্স ছাড়া ইন্টারনেট ও সাইবারক্যাফে সেবা দিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করবে বিটিআরসি। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বিটিআরসি থেকে লাইসেন্স না নিয়ে ইন্টারনেটসহ সাইবারক্যাফে সেবা দিলে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর বিধান অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতে ফৌজদারি মামলা করা হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, লাইসেন্স ছাড়া টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ সেবা দেওয়ার অপরাধে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৩০০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। আর সে কারণে আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অবিলম্বে বিটিআরসি থেকে সাইবার ক্যাফেসহ ইন্টারনেট সেবা দিতে লাইসেন্স নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর