বৃহস্পতিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

দখল দূষণে ২১ খাল নিশ্চিহ্ন

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও রাহাত খান, বরিশাল থেকে

দখল দূষণে ২১ খাল নিশ্চিহ্ন

নদী-খালের জন্য বিখ্যাত বরিশাল শহরে এখন আর খালের রাজত্ব নেই বললেই চলে। কাগজে-কলমে ২১ খালের নাম থাকলেও এখন এগুলোর অস্তিত্ব বিলীন। কোনো কোনো খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। আবার কোনো খালের ওপর গড়ে গড়ে উঠেছে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, খাল দখল করে একটি সড়কও নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি খালে বাঁধ দিয়ে করা হচ্ছে মাছ চাষ। শুধু দখল করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি দখলদাররা, এই নগরের খালগুলো বানিয়েছে ময়লা-আবর্জনার ডাস্টবিন। পচা দুর্গন্ধে খালের পাশ দিয়ে যাওয়া যায় না। কাপড় দিয়ে নাক চাপটে থাকতে হয়। এ যেন খাল দখলের মহোৎসব চলছে। আর চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটলেও নিশ্চুপ রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বরিশাল সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদফতেরর মধ্যে সমন্বয়হীনতার সুযোগে দখল আর দূষণে নিশ্চিহ্ন বরিশালের ২১টি খাল। আর এ জন্য দায়িত্বে থাকা এসব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চরম উদাসীনতাই দায়ী বলে জানিয়েছেন নগরবাসী। বয়োবৃদ্ধদের মুখে ২১টি খালের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে রয়েছে ভিন্ন চিত্র। এক সময় এই শহরের সৌন্দর্যই ছিল প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এসব আকাবাঁকা খাল। এসব খাল দিয়ে শহরঘেঁষা কীর্তনখোলা, তালতলী ও কালিজিরা নদী থেকে বড় বড় গয়না, মালবাহী নৌযান এসে মাল ও যাত্রী উঠানামা করত। কাগজে-কলমে এসব খালের নাম থাকলেও এখন দখল হয়ে স্থানে স্থানে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ২১টি খালের মধ্যে ২-৩টি খাল ড্রেনে রূপ নিলেও বাকিগুলো হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। আর এতে সৌন্দর্য হারিয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের রাজধানী বরিশাল শহর। এক সময় শহরের বিভিন্ন এলাকায় অন্যান্য জেলা থেকে নৌযান নিয়ে মোকাম করতে হাজার হাজার মানুষের ব্যস্ততা ছিল। আজ এসব কল্পকাহিনীতে রূপ নিয়েছে। এখানকার সাধারণ মানুষ নদী-খালকে কখনোই অভিশাপ হিসেবে দেখেন না। একশ্রেণির সুবিধাভোগীরা এসব খাল মনগড়া মতো যে যেভাবে পেরেছে সে সেভাবেই দখল করে নিয়েছে। তবে সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা নন্দিতা বসু বলেন, খাল দখল করে বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যারা বানিয়েছেন বিভিন্ন কারণে তাদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। সরেজমিন দেখা যায়, নগরীর বটতলা বাজার থেকে চৌমাথা পর্যন্ত বটতলা নামের একটি বড় আকৃতির খাল ছিল। যেখানে গয়না ও বড় পণ্যপাহী নৌযান এসে ভিড়ত। আজ সেই খাল ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করেছে সিটি করপোরেশন। সড়কের পাশ দিয়ে ছোট্ট একটি বক্সড্রেন (ফুটপাথ) নির্মাণ করায় মানচিত্র থেকে সম্পূর্ণ হারিয়েছে। অপরদিকে বটতলা হয়ে জিলা স্কুলের পাশ দিয়ে ভাটার খাল নামে একটি খাল ছিল। খালটির কিছু অংশ ভরাট করে সড়ক ও বাকি অংশে সরু আকৃতির ড্রেন বানিয়েছে। অপরদিকে জেল খাল এতটা প্রশস্ত ছিল যেখানে দক্ষিণাঞ্চলের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পণ্য আনা-নেওয়ার গয়না চলাচল করত। কিন্তু আজ এই জেল খালের দুই পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্থাপনা। শুধু তাই নয়, এই খালের শাখা নথুল্লাবাদ খালও এখন দখল হয়ে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। কাজীপাড়া খাল, সাগরদী খাল, টিয়াখালী খাল, জিয়াসড়ক খাল, আমানতগঞ্জ খাল, নবগ্রাম খাল, ভাটার খাল, কাশীপুর খাল, লাকুটিয়া খাল, চাঁদমারি খাল, পলাশপুর খালসহ ২১টি খাল এখন শুধু সাধারণের মুখেই রয়েছে। শহরের সাগরদী খালের দুই পাশে এমনভাবে দখল করা হয়েছে, যা দিয়ে কোনো নৌযান যাবে তো দূরের কথা পানি চলতেও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। মল্লিকবাড়ি এলাকায় সাগরদি খাল দখল করে সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর (সাবেক) অফিস বানিয়েছে। জেল খাল কীর্তনখোলা নদী থেকে উত্পত্তি হয়ে বরিশাল শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছিল। এক সময় এই জেল খাল দিয়ে গয়নার নৌকা, মালবাহী নৌযান, যাত্রীবহনের নৌযান দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করত। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও খালে পানিতে থৈ থৈ করত। কিন্তু আজ দখলের কবলে পরে শুধু নামেই আছে এই জেল খাল। একই অবস্থা ছিল সাগরদী খালের। আজ এই সাগরদী খালের কোনো চিহ্ন নেই। বিসিসি সূত্রে জানা গেছে, শহরের ২১ খাল দখলমুক্ত করে সংস্কারের জন্য একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী খান মো. নূরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হারিয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তবে আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতর পরিচালক সুকুমার বিশ্বাস বলেন, সাধারণত মানুষের জীবনে মাটি, বায়ু, পানির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। সেক্ষেত্রে পানির সঠিক প্রবাহ বন্ধ করে উন্নত জীবন করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এসব বিষয়ে নজর দেওয়া। দেশে জলাশয় আইন আছে। তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না।

বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিণ্টু বলেন, আজ আমাদের ঐতিহ্য নদী ও খাল দুটোই হারিয়ে গেছে। বিশেষ করে বরিশাল শহরের বিভিন্ন বড় বড় খাল এখন ভরাট করে দখলে নিয়েছে একশ্রেণির মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক বলেন, যথাযথ তদারকির অভাবে খালগুলো হারিয়ে গেছে। এতে বর্ষা মৌসুমে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে খালগুলোকে পুনরুদ্ধার জরুরি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর