রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

মানুষের নিষ্ঠুরতা বাড়ছে

গণপিটুনিতে এক বছরে নিহত ১৩২, শিশু হত্যা এখন নৈমিত্তিক পৈশাচিকতা

জিন্নাতুন নূর

রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং মারদাঙ্গা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটায় বাংলাদেশের মানুষের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে। জীবনযাত্রা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া দেশে নেই চিত্ত বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। এর ফলে দেশের মানুষ সহিংস হয়ে উঠছেন। এ ছাড়া বিষণ্নতা এবং কিছু ক্ষেত্রে মাদকাসক্তি থেকেও মানুষের আচরণে নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হওয়ার কারণে অতীতের চেয়ে এখন তুলনামূলক বেশি মানুষের মধ্যে সহিংস আচরণের প্রকাশ ঘটছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ এখন তার রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করেই তার তাত্ক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ করছেন। যার ফলে গণপিটুনিতে মানুষ ও শিশু হত্যার পরিমাণ বেড়েছে। অপরাধীদের হত্যাকাণ্ডেও এসেছে নানা পৈশাচিক ধরন। এমনকি মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে পারিবারিক হত্যাকাণ্ডে ঘটনাগুলোও দিনকে দিন মহামারীতে রূপ নিচ্ছে।

মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশ্বমিডিয়া আমাদের ক্রমেই অপসংস্কৃতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলো সহিংসতা শেখাচ্ছে। এমনকি বাচ্চাদের কার্টুনেও সহিংসতা দেখানো হচ্ছে। অসচ্ছল মানুষজন একসঙ্গে গাদাগাদি করে ছোট জায়গায় থাকছেন। ফলে মানুষের মন পরিশুদ্ধ হওয়ার উপায় নেই। এর ফলে মানুষের মধ্যে বিকৃতি বাড়ছে। মন থেকে কোমল অনুভূতি চলে যাচ্ছে। মানুষ ক্রমেই পাশবিক হয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকলে এটা হতো না। এখন রাজনৈতিক ক্যাডাররা সব নিয়ন্ত্রণ করছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধী অপরাধ করেও ভয় পাচ্ছে না।

শিশু হত্যা : দেশে এখন শিশুর অপহরণ ও হত্যা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করা এক ধরনের ‘ব্যাধি’-তে পরিণত হয়েছে। এর কারণে শিশুদের এখন ‘পাখি’র মতো হত্যা করা হচ্ছে। মানুষ তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তাত্ক্ষণিক রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। এর ফলস্বরূপ এক শ্রেণির মানুষ শিশুদের পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করে হত্যা করছে। সাবেক তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম এই প্রতিবেদককে বলেন, শিশুদের হত্যায় এখন নানা ধরনের কৌশল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু যারা এই নির্মম নির্যাতন ও হত্যা করছেন তাদের সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। তারা কোনো ধরনের পরিবারের সদস্য, তাদের রাজনৈতিক আদর্শই বা কী, এই সহিংসতা তারা আকাশ সংস্কৃতি থেকে শিখছেন কিনা ইত্যাদি খতিয়ে দেখতে হবে। উদ্বেগজনক বিষয় এই যে, শিশুদের ওপর এখন নির্মম নির্যাতনের ধরন নিয়েও হত্যাকারীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশু নির্যাতন বন্ধে আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। শিশু হত্যার ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে সরকারকে জিরো টলারেন্সে যেতে হবে। এ ব্যাপারে সবার আগে আইন প্রণেতাদের কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। সচেতনতা তৈরিতে এলাকায় এলাকায় কমিউনিটি ওয়ার্কশপ করতে হবে। প্রয়োজনে জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য দরকারে থানা ঘেরাও ও জনপ্রতিনিধিদের বাসা ঘেরাও করতে হবে। দ্রুত বিচারে শিশু হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বা ফাঁসির ব্যবস্থা করতে হবে।

গণপিটুনি : মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর দেওয়া তথ্যে, ২০১৫ সালে দেশে বিচারবহির্ভূতভাবে মোট ১৮৫ জনকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে শুধু গণপিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ১৩২ জন। মানবাধিকার সংস্থাটি আরও জানায়, এর আগে ২০০৯ সালে ১২৭, ২০১০ সালে ১৭৪, ২০১১ সালে ১৬১, ২০১২ সালে ১৩২, ২০১৩ সালে ১২৫, ২০১৪ সালে ১১৬ ব্যক্তি গণপিটুনিতে মারা যান। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইনের প্রতি আস্থা রাখতে না পেরে মানুষ এখন আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। পিটিয়ে মানুষ হত্যা এখন বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে। এটি প্রতিরোধে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে এবং প্রত্যেক এলাকার জনপ্রতিনিধিদের চোর-ডাকাত ধরা পড়লে তাকে সাধারণের হাতে গণপিটুনির জন্য ছেড়ে না দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের সমাজে সাধারণ মানুষ ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ পায় না। তারা পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রের অস্থিরতা এবং অশান্তির পর দিনশেষে ক্লান্ত দেহে যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন তখন রাস্তায় কোনো চোর-ডাকাতকে অন্যদের মারতে দেখলে নিজেও তাকে দুই ঘা দিতে উত্সাহিত হন। এর মধ্যে সাধারণ মানুষ এক ধরনের ‘বিকৃত’ বিনোদন খুঁজে পান। আর আগে থেকেই এদেশে চোর-ডাকাত ধরা পড়লেই তাকে পিটিয়ে হত্যা করার এক ধরনের রেওয়াজ আছে। তিনি বলেন, এদেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এক ধরনের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। এটি প্রতিরোধে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এ জন্য শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি মানুষের মাঝে এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

পারিবারিক হত্যাকাণ্ড : এমনকি বাংলাদেশে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে পরিবারগুলোকেও। দেশে এখন প্রতিদিনই ঘটছে একাধিক পারিবারিক হত্যাকাণ্ড। মা-বাবা, সন্তান, ভাই-বোন, মামা-ভাগ্নে, চাচা-ভাতিজা, ভাবী-দেবর, বউ-শাশুড়ি, মেয়েজামাইসহ নিকট আত্মীয়দের মধ্যেই ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। আর হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে— অর্থলোভ, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, অন্যদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা, দাম্পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসহীনতা, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার ইচ্ছা, সামাজিক উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাষ্ট্রের উদাসীনতা, বিষণ্নতা ও মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে এ ধরনের খুনের ঘটনাগুলো ঘটছে। বিশেষজ্ঞ মহল বলছেন, কার্যকর বিচারব্যবস্থার অভাবে অপরাধীরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না থাকায় অন্য আরেকটি পরিবারেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পারিবারিক হত্যাকাণ্ডগুলোকে মনোচিকিত্সক ডা. মোহিত কামাল বিপজ্জনক রোগের লক্ষণ হিসেবে মনে করছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে ব্যক্তি তার স্বজনকে হত্যার মতো অপরাধ করছেন তিনি অতিরিক্ত বিষণ্নতা থেকেই এ কাজ করছেন বলে ধারণা করা হয়। কিছুক্ষেত্রে রোগী তাত্ক্ষণিক তাড়না থেকেও তার পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি করতে পারেন। সাধারণত ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা এ ধরনের কাণ্ড ঘটান।

শিশু-কিশোরদের আচরণেও পরিবর্তন : সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা আরও জানান, বর্তমানে শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আচরণেও নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। সামাজিক মূল্যবোধহীন এক সমাজে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা ক্রমেই অস্থির ও সহিংস হয়ে উঠছে। মনোবিজ্ঞানীরা জানান, অস্থির ও বাণিজ্য নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় শিশু-কিশোররা সহিংসতামূলক আচরণে প্রলুব্ধ হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে দেশে সুস্থ বিনোদনের যথেষ্ট অভাব। ছেলেমেয়েদের সংস্কৃতি ও শরীরচর্চার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের কারণেও ছেলেমেয়েদের আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, প্রযুক্তি অনেকটা ‘ছুরির’ মতো। বর্তমানে এর অনেক অপব্যবহার হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর