শিরোনাম
বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

তৃণমূলে সংকটে দুই দলই

নতুন নেতৃত্বেও কোন্দল থামেনি আওয়ামী লীগে

রফিকুল ইসলাম রনি

তৃণমূলে সংকটে দুই দলই

নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের সঙ্গে জেলা সহ-সভাপতি সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকারের রাজনৈতিক বিরোধ পুরনো। বিগত সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর থেকেই জেলা রাজনীতিতে কোণঠাসা করে রাখা হয় আহাদ আলীকে। সম্প্রতি সক্রিয় হওয়ায় মঙ্গলবার তার নাটোর শহরের জেলেপাড়ার বাসায় হামলা চালায় শিমুলের সমর্থনপুষ্ট ‘হ্যান্ডকাফ সাব্বির’ বাহিনী। আহাদ আলী সরকারের অভিযোগ, দলে আমার ভাবমূর্তি ভালো দেখে এমপি শিমুল তার লোকজন দিয়ে বাড়িতে হামলা করে। শফিকুল ইসলাম শিমুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, তিনি এ ঘটনায় কোনোভাবেই জড়িত নন। এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

গত বছর সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব এলেও সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের দুটি ধারা এখনো বিদ্যমান। একটি ধারার নেতৃত্বে জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম। আরেকটি ধারার নেতৃত্বে বর্তমান সভাপতি মনসুর আহমেদ ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক। তাদের সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ। একাধিক ধারায় বিভক্ত নেতারা একেকজন একেক স্থানে বসেন। ফলে সাধারণ কর্মীদের একত্র হওয়ার কোনো সুযোগ বা ঠিকানা নেই। ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক কোরাইশীর মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে। দবিরুল ইসলাম জেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে হেন কাজ নেই যা করেন না। সঙ্গে আছেন ছেলে মাজহারুল ইসলাম সুজন। ওই জেলার সভাপতিও বলতে গেলে তিনি, সাধারণ সম্পাদকও। সাদেক কোরাইশীকে ছাড়াই সব সিদ্ধান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়। নামমাত্র পদে রয়েছেন কোরাইশী।

এমন চিত্র শুধু নাটোর, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও জেলাতেই নয়, এটা কম-বেশি আওয়ামী লীগের প্রায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার চিত্র। সম্মেলনের মাধ্যমে জেলার নতুন নেতৃত্ব এলেও এখনো অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, সুযোগসন্ধানীদের তত্পরতাসহ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত তৃণমূল আওয়ামী লীগ। এমপি-মন্ত্রীদের পাশে এখন ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ভিড়তে পারেন না। ভুঁইফোড়রাই নেতৃত্বের অগ্রভাগে। আদর্শ ও লক্ষ্য অভিন্ন, তবুও দুই মেরুতে অধিকাংশ নেতা। জেলার শীর্ষ দুই নেতাকে ঘিরে কর্মীরাও বিভক্ত। কর্মসূচিও পালন করা হয় পৃথকভাবে। এ অবস্থায় ছয় মাস কি দেড় বছর আগে সম্মেলন সম্পন্ন হওয়া বেশ কিছু জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কমিটি গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। দলীয় সূত্রমতে, এমপি-মন্ত্রীদের কারণে জেলার দলীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থাকা ত্যাগী, সংগ্রামী ও কর্মীবান্ধব নেতারা এখন কোণঠাসা। ত্যাগী নেতাদের কোনো মূল্যায়ন নেই দলে। নেতৃত্ব ও ক্ষমতা এখন হাইব্রিড নেতৃত্বের কব্জায়। উড়ে এসে জুড়ে বসা এসব নেতার দলে আবেদন না থাকলেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কর্মীদের কাছে তারা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অনেকেই ব্যস্ত দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে আখের গোছাতে। সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। অনেক জেলায় দিবসভিত্তিক ছাড়া কোনো কর্মসূচিই পালন করা হয় না। কোন্দলে কাবু ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ। বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান একাংশের নেতৃত্বে রয়েছেন। আরেক অংশে রয়েছেন জেলা সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদ প্রশাসক অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা এবং ময়মনসিংহ পৌর মেয়র ইকরামুল হক টিটুর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অন্য একটি অংশ। এতে দলীয় রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ২০১৪ সালের শেষের দিকে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় ১৪ জনকে নতুন করে কো-অপ্ট করা হয়। সদর আসনে জাতীয় পার্টির এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপির হওয়ায় পৌর মেয়র টিটুকে দলীয় পদ দেওয়ার দাবি জানান দলের বিভিন্ন নেতা-কর্মী। কিন্তু তাকে পদে রাখা হয়নি। মূলত সেদিন থেকেই জেলা আওয়ামী লীগরে দুই পক্ষের বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। এমনকি সেই থেকে দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিও আলাদা করে পালন করছে দুটি পক্ষ। দলীয় সূত্রমতে, বেশ কিছুদিন আগে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় অনুপস্থিতি ও নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন সরকারকে অব্যাহতি দিয়ে দুই নম্বর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও হালুয়াঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক আহম্মেদ খানকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আবার জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা ও ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু বলয়ে ঠিকই সক্রিয় হয়ে রাজনীতি করছেন দলীয় সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন সরকার। ফলে সাধারণ সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে কে বৈধ, আর কে অবৈধ— এ নিয়ে তুলকালাম চলছে দলের ভিতরে-বাইরে। শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে ঘিরেও কদিন যাবৎ চলছিল দলীয় নেতা-কর্মীদরে ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা। ২৪ জানুয়ারি অধ্যক্ষ মতিউর রহমান গ্রুপ কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলন নির্ধারণ করে। এরই পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে খোকা-টিটু বলয়ের নেতা-কর্মীরা ৬ ফেব্রুয়ারি ডাক দেন শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলন। অবশ্য ৫ ফেব্রুয়ারি দুই পক্ষই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে সম্মেলন বাতিল করে। নেত্রকোনার আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মতিয়ার রহমান খান আর সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী খান খসরুর মধ্যে চরম বিরোধ রয়েছে। দলাদলিতে জর্জরিত শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগও। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নেত্রী মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব্ব জেলা সভাপতি আতিউর রহমান আতিকের। এ জেলায় আওয়ামী লীগ চলছে দুটি ধারায়। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগও চলছে দুই গ্রুপে। এক পক্ষের নেতৃত্বে জেলা সভাপতি ও সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। আরেক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির। বিগত পৌরসভা নির্বাচনে এ দুই নেতাই দলের প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী দাঁড় করিয়ে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নেতা-কর্মীরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের মধ্যে বিরোধ স্পষ্ট। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও মহানগর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজালুল করিমের মধ্যে বিরোধের কথা অনেক নেতা-কর্মীর মুখে মুখেই। একাধিক ধারায় বিভক্ত কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয় গত বছরের ২৫ নভেম্বর। কাউন্সিলে ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা সদর উদ্দিন খানকে সভাপতি ও আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক আজগর আলীকে একই পদে রেখে কমিটি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে কাউন্সিলে কমিটি ঘোষণার আগেই শহরের আড়ুয়াপাড়ায় আওয়ামী লীগের পুরাতন জেলা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি পৌর মেয়র আনোয়ার আলীকে সভাপতি ও কুষ্টিয়া-৪ (খোকসা-কুমারখালী) আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রউফকে সাধারণ সম্পাদক করে আরেকটি কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে সদর উদ্দিন খানের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করছে। অন্যদিকে আনোয়ার আলীও নিজেকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দাবি করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। উভয় পক্ষই কেন্দ্রে জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিয়েছে। তবে এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হয়নি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর