শিরোনাম
সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রশাসনের ভূমিকায় ছাত্রলীগ!

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চিত্র

আকতারুজ্জামান

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের বড় আতঙ্কের নাম ‘সিট পলিটিক্স’। ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়াতে হল বরাদ্দ পাওয়ার আগেই রাজনৈতিক দলের ‘বড় ভাই’রা দায়িত্ব নিয়ে ছাত্রদের আবাসিক হলে তুলে নেন জুনিয়র শিক্ষার্থীদের। তারপর তাদের মাধ্যমে করানো হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি। কর্মসূচির নামে চালানো হয় কোনো কোনো সময় নির্যাতন। হল পাহারা দেওয়া, নাইট ডিউটি করা, গণরুমে গাদাগাদি করে থাকা, র্যাগিংয়ে অংশ নেওয়া, গেস্ট রুমে নিয়মিত যাওয়া-আসা করতে হয় এই জুনিয়রদের। ছাত্র সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বিরোধী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধলেও এই জুনিয়রদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র, এমন নজিরও বিরল নয়। আর বিভিন্ন রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং তো রয়েছেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছাত্র সংগঠনগুলোর খপ্পরে পড়েন নবীন শিক্ষার্থীরা। এরপর আর লেজুড়বৃত্তির ছাত্র সংগঠনগুলোর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না শিক্ষার্থীরা। এভাবে দিনের পর দিন ক্লাস পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হচ্ছে তাদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হল প্রশাসন কার্যত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে জিম্মি। বর্তমানে ঢাবির হলগুলোতে প্রশাসনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ। ভর্তির পর একজন শিক্ষার্থীকে হলে থাকার ব্যবস্থা, কক্ষ বরাদ্দ, এমনকি আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়াসহ নানা কাজ পরোক্ষভাবে পালন করছে এই ছাত্রসংগঠনটি।

অনেক ভুক্তভোগী জানান, ঢাবির হলগুলোতে প্রশাসন নামেমাত্র কক্ষ বরাদ্দ দেয়। প্রশাসনের বরাদ্দকৃত সিটে উঠতেও পারে না শিক্ষার্থীরা। সিটে তোলা, খালি করার পাশাপাশি এমনকি সিট ভাড়াও দিচ্ছেন কতিপয় ছাত্রলীগ নেতা। এ ছাড়া আবাসন সমস্যাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের জোর করে দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করছে সংগঠনটি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হল প্রশাসনের তদারকির অভাবে হলের সিট বণ্টনে নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাদের।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান গত রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে দাবি করেন, ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সিট বরাদ্দ দেয় না। প্রশাসনের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা হলে ওঠেন। তবে গণরুমের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে কিছু শিক্ষার্থী তোলেন। জোর করে রাজনৈতিক কর্মসূচি, নাইট ডিউটির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। গেস্টরুম করার ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা একটা মতবিনিময়ের মতো। জোর করে শিক্ষার্থীদের আনা হয় না এখানে। তারা নিজ থেকেই আসেন। জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লা। ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ মাধ্যমে উঠেছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে। শীতকালেও তাকে থাকতে হতো বারান্দায়, যেতে হতো বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। তীব্র শীতে ধকল সইতে না পেরে হাফিজুর আক্রান্ত হয় নিউমোনিয়া ও টাইফয়েডে। এরপর তিনি মারা যান। হাফিজুরের সহপাঠী ও পরিবারের অভিযোগ, শীতের মধ্যে বারান্দায় থাকা এবং রাতে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে হাফিজ ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় তীব্র শীতের মধ্যেও হাফিজকে রাতে বাইরে ডিউটি করতে হয়েছে বলেও অভিযোগ তার সহপাঠীদের। তাকে প্রায়ই অন্য কর্মীদের সঙ্গে হলের ‘গেস্টরুম’ও করতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয়টির সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. গোলাম মোহাম্মদ ভূঞা গত রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবৈধভাবে যদি কেউ হলে থাকেন তবে তার দায় তো প্রশাসন নেবে না। যদি কোনো সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা হলে ওঠে এ ব্যাপারে ওই সংগঠনকেই জিজ্ঞাসা করুন। বৈধ কোনো শিক্ষার্থী হলে উঠতে ও অবস্থান করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেউ রাজনৈতিক সংগঠনের বিরুদ্ধে হেনস্তা বা নিপীড়নের অভিযোগ আনলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একই চিত্র। অভিযোগ আছে এখানেও প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ‘সিট পলিটিক্স’র প্রভাব খাটায়। প্রতিবছর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে প্রবেশ করলেই তাদের নিয়ে চলে রাতভর নানা ‘কর্মসূচি’। প্রথমদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসব শিক্ষার্থীকে নিয়ে গেস্টরুমে ব্যস্ত থাকেন। এ ছাড়া ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিং সমাবেশে জোরপূর্বক এসব শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাওয়ারও অনেক অভিযোগ রয়েছে। এমনকি দুই আবাসিক হলের মধ্যে সংঘর্ষকালে জুনিয়রদের হাতে জোরপূর্বক দেশিও অস্ত্র তুলে দেওয়ারও নজির রয়েছে। এসব মারামারিতে অংশ নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেই চড়-থাপ্পড়সহ হল থেকে বের করে দেওয়ারও হুমকি দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা ওইসব নেতার কথামতো কাজ করেন বলে জানান ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের হলে তুলে তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাপ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচির চাপে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না অনেক শিক্ষার্থী। দিনের পর দিন ক্লাস পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হচ্ছে তাদের। নবাব আবদুল লতিফ হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান বলেন, হল ইউনিটের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সময় বিভিন্ন চাপ নিতে হচ্ছে ছাত্রলীগকে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে জুনিয়রদের হল থেকে নিয়ে যেতে হয়। এটা করতে গিয়ে পড়াশোনার সমস্যা যে হয় না তা বলা কঠিন। তবে সংগঠনকে ভালোবেসে আমাদেরকে তা করতে হয় বলেও জানান এই নেতা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য চারটি হল রয়েছে। শিক্ষার্থীরা মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ পেলেও হলে উঠতে হয় ছাত্র সংগঠনের ‘হাত ধরে’। এ ছাড়া কারও হলে সিট মেলে না। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হল প্রাধ্যক্ষরাও ছাত্রদের বৈধ সিটে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না।  [(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ফরহাদ উদ্দীন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাহিদুর রহমান হিমেল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জয়শ্রী ভাদুড়ী)।]

সর্বশেষ খবর