শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

উধাও ৬৬ খুনি

আহমেদ আল আমীন

উধাও ৬৬ খুনি

মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও বিচারের আওতায় আসা মামলাগুলোর প্রায় দেড়শ আসামির মধ্যে ৬৬ জনই পলাতক। পলাতকের এ তালিকায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যেমন রয়েছেন, তেমন আছেন তদন্তাধীন আসামিও। এদের মধ্যে দণ্ডিত পলাতকের সংখ্যা ৬। পলাতক থাকায় এই আসামিরা দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলও করতে পারেননি। পলাতক আসামির তালিকা দিন দিন বাড়ছেই। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্রসিকিউশনের মাধ্যমে তদন্ত সংস্থা আবেদন করে, ট্রাইব্যুনালও পরোয়ানা জারি করেন; তবে গ্রেফতার হন না আসামি। ফলত বাড়ছে পলাতক আসামির সংখ্যা। বিষয়টি নজরে আসায় বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এভাবে গ্রেফতারে ব্যর্থতা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কোনো আসামিকে কাঠগড়ায় রেখে হয়তো আর বিচার করা যাবে না।

প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ পলাতক আসামির এ সংখ্যায় উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসামি গ্রেফতারে যথাসময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন। পলাতক আসামির বিচারে মনস্তাত্ত্বিক বিজয় হলেও তাতে রায় কার্যকর হয় না।

দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামির মধ্যে রয়েছেন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, চৌধুরী মাঈনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খান, জাহিদ হোসেন খোকন, আবদুল জব্বার ও সৈয়দ মোহাম্মদ হাছান আলী। এর মধ্যে বাচ্চু রাজাকার জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য। মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান একাত্তরে ছিলেন ঘাতক সংগঠন আলবদর বাহিনীর সদস্য। খোকন স্থানীয় বিএনপি নেতা। কিশোরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার ছিলেন হাছান আলী। এরা সবাই মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আর আবদুল জব্বার ছিলেন জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা। বিচারে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে।

জামালপুরের আটজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের পরোয়ানা জারি করা হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। পরোয়ানার পর এ মামলায় মোহাম্মদ শামসুল হক এবং এস এম ইউসুফ আলীকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারলেও বাকি ছয়জন এখনো পলাতক। গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পলাতক রয়েছেন মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, মোহাম্মদ আবদুল বারী, মো. হারুন ও মোহাম্মদ আবুল হাসেম। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কিশোরগঞ্জের পাঁচজনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা থাকলেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন মাত্র একজন। এ মামলায় মো. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, মো. শামসুদ্দিন আহমেদ, গাজী আবদুল মান্নান, হাফিজ উদ্দিন ও আজহারুল ইসলামকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একটি মামলায় যশোরের নয়জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা রয়েছে। কিন্তু পুলিশ এ পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছে। এ মামলায় পলাতক আসামিরা হলেন— মো. ইব্রাহিম হোসেন, শেখ মো. মজিবুর রহমান, মো. আবদুল আজিম সরদার, মো. আজিজ সরদার, কাজী ওয়াহেদুল ইসলাম ও মো. আবদুল খালেক মোড়ল। এ মামলায় কারাগারে রয়েছেন সাখাওয়াত হোসেন, মো. বিল্লাল হোসেন ও মো. লুত্ফর মোড়ল। এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল। মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় গত বছরের ২১ মে কক্সবাজারের ১৬ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় পরবর্তীতে যুক্ত হন আরও তিন আসামি। এ ১৯ জনের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন মোট সাতজন। এর মধ্যে গ্রেফতারের পর হাসপাতালে মারা যান একজন। বাকি ১২ আসামি পলাতক এখনো। মৌলভীবাজারের চারজনের মধ্যে আকমল আলী গ্রেফতার। পলাতক তিনজন হলেন— আলাউদ্দিন আলী, লাল মিয়া ও মো. মতিন মিয়া। হবিগঞ্জের লিয়াকত আলীসহ দুই আসামি পলাতক। নেত্রকোনার আটপাড়া এলাকার সোহরাব ফকির গ্রেফতার হলেও হেদায়েত উল্লাহ আনজু ও এনায়েত উল্লাহ মনজুকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য আবু সালেহ মুহাম্মদ আবদুল আজিজ মিয়া ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এক মামলায়। আজিজ ছাড়া বাকি পাঁচ আসামি হলেন— মো. রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জু, মো. আবদুল লতিফ, আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী, মো. নাজমুল হুদা ও মো. আবদুর রহিম মিঞা। এ মামলার সব আসামিই এখনো পলাতক। এদের বিরুদ্ধে একাত্তরে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটকে রাখা, নির্যাতন, লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। নোয়াখালীর পাঁচজনের মধ্যে চারজনই পলাতক বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম। শরীয়তপুরের সোলায়মান মোল্লা গ্রেফতার হলেও এ মামলার আরেক আসামি ইদ্রিস আলী সরদার পলাতক। এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। তারা দুজনই রাজাকার। এ মামলায় তিন শতাধিক হত্যা, গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এ মামলায় রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি মামলায় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আটজনের মধ্যে তিনজন পলাতক। অন্য একটি মামলায় ময়মনসিংহের আটজনের চারজন পলাতক। একটি মামলায় মৌলভীবাজারের পাঁচজনের তিনজন পলাতক। প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান জানান, নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার সাত আসামির পাঁচজনই পলাতক। এ মামলায় গ্রেফতার হন আহমদ আলী ও আবদুর রহমান। তবে কারাগারে মারা যান আহমদ আলী। ময়মনসিংহের আরেক মামলায় তিন আসামির মধ্যে গ্রেফতার আমজাদ আলীকে ঢাকায় আনার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। আসামি রিয়াজউদ্দিন কারাগারে। এ মামলার অন্য আসামি ওয়াজউদ্দিন পলাতক। এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হত্যা ও লুটের অভিযোগ রয়েছে। এ মামলায় ১৩ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে। এ মামলায় রাষ্ট্রীয় খরচে আসামিপক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে।

গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন— জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, এ কে এম ইউসুফ ও আবদুস সুবহান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুল আলীম। এরশাদ সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার। বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, খান মোহাম্মদ আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালুকদার, হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান ওরফে বড়মিয়া, মজিবুর রহমান ওরফে আঙ্গুর মিয়া ও আবদুর রাজ্জাক, পটুয়াখালীর মো. ফোরকান মল্লিক, নেত্রকোনার ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. মোবারক হোসেন। এ আসামিরা মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন বিচারিক আদালতে। আপিল নিষ্পত্তির পর কারও কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আবার দণ্ড ভোগরত অবস্থায় কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন কেউ কেউ। কারও কারও আপিল এখন বিচারাধীন।

প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা বলেন, পরোয়ানাভুক্ত আসামি গ্রেফতার না হওয়ার ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল বেশ কয়েকবার অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন। তা ছাড়া আসামি গ্রেফতার না হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও মামলার সাক্ষীরা হতাশ ও বিভ্রান্ত হন। তাই আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের আরও সক্রিয়া হওয়া উচিত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর