শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাল্যবিয়ে ঠেকাতে আট বন্ধুর লড়াই

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

বাল্যবিয়ে ঠেকাতে আট বন্ধুর লড়াই

দুই বছর আগের কথা। রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছী পশ্চিম পাড়ার বাবুর সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে হ্যাপির বিয়ে ঠিক করেন পরিবারের সদস্যরা। বাল্যবিয়ে নারীর জন্য অভিশাপ— বিষয়টি বোঝাতে বাবুর বাড়িতে ছুটে যান জাগো নারী যুব উন্নয়ন সদস্যরা। অবশেষে বন্ধ হয় হ্যাপির বিয়ে। একইভাবে ওই এলাকার সুলতানের অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া সালমার বিয়ে বন্ধ করেন তারা। বড়গাছী গ্রামের যুবক জয়নাল আবেদীন। তারা আটজন মিলে স্বেচ্ছাশ্রমে তিন বছর ধরে অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করছেন। অবহেলিত নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের কারণেই এ পর্যন্ত পবা এলাকায় বন্ধ হয়েছে অর্ধশত বাল্যবিয়ে। শুধু তাই নয়, আশপাশে যেখানেই নারী নির্যাতনের খবর মেলে— সেখানেই প্রতিবাদ করতে ছুটে যান তারা। জাগো নারী যুব উন্নয়ন সংগঠনের সদস্য জয়নাল আবেদীন জানান, শহরের তুলনায় গ্রামে নারী নির্যাতনের ঘটনা অনেক বেশি। প্রায় ঘরেই কোনো না কোনোভাবে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কেউ বাল্যবিয়ে, কেউ যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ছোট থেকেই বিষয়টি ভালোভাবেই নাড়া দিয়েছিল তাকে। সেই থেকে গ্রামের অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা জন্ম নিয়েছিল তার ভেতর। তাই বন্ধুদের নিয়ে জাগো নারী যুব উন্নয়ন সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রথমে মাত্র তিনজনকে নিয়ে জাগো নারী যুব উন্নয়ন সংগঠন যাত্রা শুরু করে। জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে যোগ দেন আজিজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আনজু আরা। তিন বছরে জাগো নারী যুব উন্নয়ন সংগঠনে আরও জন সদস্য যোগ দিয়েছেন। তারা হলেন পবা উপজেলার বায়া বিশুর মোড় এলাকার রোকসানা বিবি (৩১), নাসির উদ্দীন (২৮), সুমি বিবি (২৮), বড়গাছী পশ্চিমপাড়া এলাকার শরিফ (২৩) ও আপন (২৩)। সংগঠনের যার যেখানে বাড়ি যেখানে, সেখানেই তারা নারীদের উন্নয়ন ও সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করছেন। তবে কাজ করতে গিয়ে তাদের নানা বাধার মুখে পড়তে হয়। সংগঠনের নারী সদস্য রোকসানা বলেন, ‘বাল্যবিয়ে আমাদের সমাজের একটি বড় ব্যাধি। অনেক মা-বাবা নিজেদের অজান্তেই তাদের সন্তানদের এ হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। আশপাশের এলাকায় যখন বাল্যবিয়ের কথা জানতে পারি তখন সংগঠনের সদস্যরা মিলে ওই বাড়িতে ছুটে যাই। কিন্তু বোঝাতে অনেক কষ্ট হয়।’ তিনি জানান, যখন তারা ব্যর্থ হন তখন আশপাশের মুরব্বিদের সহযোগিতা নেওয়া হয়। এ ধরনের সমস্যা সমাধান করতে গেলে অনেকেই তাদের শত্রু মনে করেন। আসলে বাল্যবিয়ের যে কত ক্ষতি— তা তারা জানেন না।

নাসির উদ্দীন জানান, আশপাশের এলাকায় এ পর্যন্ত তারা সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনজনের বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন। প্রতি সপ্তাহে অন্তত আধা ঘণ্টা হলেও জাগো নারী যুব উন্নয়ন সংগঠনের সদস্যরা এক জায়গায় আলোচনায় বসেন। তখন যে যার এলাকার নারীর সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয় কোন সমস্যা নিয়ে কাজ করা হবে। সদস্য আজিজুল ইসলাম জানান, তাদের বন্ধুদের সহযোগিতায় বিভিন্ন গ্রামের নারীদের নিয়ে শিক্ষামূলক আলোচনার আসর বসান। এসব আসরে নারীদের বাল্যবিয়ের কুফল, যৌতুক প্রথা থেকে শুরু করে নারী নির্যাতনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। আলোচনায় নারীদের শিক্ষিত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। এসব ক্লাস নেওয়ার জন্য তারা নিজেরাই নারীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে অভিজ্ঞ লোকদের অতিথি করে নিয়ে এসে তারা অসহায় নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে থাকেন। স্থানীয়রা মনে করছেন, বাল্যবিয়ে ঠেকাতে আট বন্ধুর লড়াই একদিন অশিক্ষিত অসচেতন সমাজের জন্য পাথেয় হয়ে উঠবে— তাতে কোনোৃ সন্দেহ নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর