শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মরণ ফাঁদ রাজপথ

ছয় মাসে সারা দেশে নিহত ১২৬৭, সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ যাত্রাবাড়ী ও বিমানবন্দর এলাকা

আলী আজম

যে কোনো মৃত্যু মানুষের জন্য বেদনাদায়ক। আর সে মৃত্যু যদি হয় দুর্ঘটনায় তাহলে বেদনার চিত্রটা হয় আরও করুণ। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত দিন দিন যেন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে পড়ছে বহু তাজা প্রাণ। মরণ ফাঁদ এখন রাজপথ। ঘর থেকে বের হয়ে গন্তব্যস্থলে না পৌঁছে লাশ হয়ে ঘরে ফিরছে। চালকের অসাবধানতা, অদক্ষতা, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন, গাড়ির প্রতিযোগিতা, রাস্তার দুরবস্থাসহ নানাবিধ কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।

এসব দুর্ঘটনায় হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অনেকে। আবার পঙ্গুত্ববরণ করেছে অসংখ্য মানুষ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় প্রতিনিয়ত ভারী হয়ে উঠছে পরিবেশ।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১ হাজার ২৬৭ জন ও আহত হয়েছে ১ হাজার ১২৩ জন। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৯১ জন আর আহত হয়েছেন ১৩১ জন। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে যাত্রাবাড়ী, দারুসসালাম ও বিমানবন্দ থানা এলাকায়। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১ হাজার ৩২৬ জন, আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৯৩০ জন। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সূত্রে জানা গেছে, গত বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ৩ জন, আহত হয়েছেন ৬ হাজার ১৯৭ জন। এসব রিপোর্টের ভিত্তিতে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১৩ জনেরও বেশি মানুষ মারা যান। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ বা নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও কার্যত তেমন কোনো সুফল আসছে না। ২০১১-২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ জাতিসংঘে অঙ্গীকার করেছিল। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে গড়ে ২৪ জন মারা যান। ২০১৪ সালের চিত্রও ছিল একই। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ৮ হাজার ৬৪২ জন আর আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাধারণত ফুটপাথ দখল, ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোড, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, গাড়ির ত্রুটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জেব্রা ক্রসিং না থাকা এবং জেব্রা ক্রসিং গাড়িচালক কর্তৃক না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করে কথা বলা, মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যান একই সঙ্গে চলাচল, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো এবং মহাসড়ক ক্রসিংয়ে ফিডার রোডে যানবাহন উঠে যাওয়াই দায়ী। সম্প্রতি পিপিআরসি ও ব্র্যাকের গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার নয়টি কারণ চিহ্নিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে— বেপরোয়া গাড়ি চালনা, চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বিভিন্ন গতির যানের একই সড়কে চলাচল, সড়কের ধারে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, সড়কের নকশায় ত্রুটি, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতার অভাব ও পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালকদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ও অপ্রতুল শাস্তির বিধান প্রভৃতি। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দায়ী করলে চলবে না। পরিবহন মালিক-শ্রমিক, হাইওয়ে পুলিশ ও বিআরটিএকে যৌথভাবে দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে পরিবহন চালক ও হেলপারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিএমবিএসের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থায় নিয়োজিত অসংখ্য অদক্ষ চালক ও হেলপার, তদুপরি পরিবহনব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে দিন দিন বেড়েই চলছে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের সংখ্যা। এ অবস্থা উত্তরণের জন্য চালক ও পথচারীদের ট্রাফিক সিগন্যাল অবশ্যই মানতে বাধ্য করতে হবে। চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলস্বন করা উচিত। যথাযথ কর্তৃপক্ষসহ ট্রাফিক পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। দুর্ঘটনায় দোষীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নিসচার চেয়ারম্যান ও চলচ্চিত্রাভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার দায় একক কোনো সংগঠনের নয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সাধারণ মানুষ, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, সংগঠন, সবারই দায়িত্ব রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব সরকারের। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৫০টির মতো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে মহাসড়কে গাড়ি চালনার নিয়মগুলো না মানা, অদক্ষ ড্রাইভার বিশেষ করে প্রশিক্ষণ ছাড়া হেলপার থেকে ড্রাইভার বনে যাওয়া, অশিক্ষিত ড্রাইভার, ওভারলোড, ওভারটেকিং, পুলিশের নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যাওয়া, গতি সম্পর্কে ধারণা না থাকা অন্যতম। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার কারণে বছরে জিডিপির দেড় থেকে দুই শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর