শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সৈয়দ শেরপুরে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছেন

শেরপুর প্রতিনিধি

বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সৈয়দ শেরপুরে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছেন

শেরপুর শহর ও আশপাশ এলাকায় ‘আওয়ামী লীগ ভাই’ নামে পরিচিত সৈয়দ এমদাদুল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অতিপ্রিয় এক মানুষ। এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও কণ্ঠস্বরে রয়ে গেছে তেজস্বিতা। শোক-দুঃখ আর আর্থিক অনটন কাতর করে রেখেছে ৯২ বছর বয়সী  এ মানুষটিকে। তবুও ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ‘সৈয়দ’। স্মৃতিকাতরতা তাকে বার বার ছুঁয়ে যায়। ফেলে আসা দিনগুলো বুকের গভীর থেকে উগরে দেয় দীর্ঘনিঃশ্বাস। বিছানাতেই পড়ে থাকেন সারা দিন। কেউ তার খোঁজ নেয় না। সকাল-সন্ধ্যা-দুপুর-রাত যেসব আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন তারাও নন।

ছয় ছেলে দুই মেয়ের জনক সৈয়দ এমদাদুল হক। রাজনীতির অঙ্গনে দিন-রাত খাটতে খাটতে সময় পাননি সন্তানদের খোঁজখবর রাখার। তাই কোনো সন্তানই বড় কিছু হয়ে উঠতে পারেননি। বাবার মতো তারাও কষ্টেসৃষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। মেয়েরা খেতে দেন তাকে ও তার স্ত্রীকে। শহরের মধ্যসেরি এলাকায় থাকার ঘরটি টিনের। তবে তারও দশা অনেকটা কবিতার আসমানীদের ঘরের মতো। শোয়ার চৌকিটি যেন এখনই ভেঙে পড়বে। চতুর্থ ছেলে সৈয়দ আল-আমিন নবম শ্রেণিতে পড়তেন আজ থেকে ১৭ বছর আগে। নতুন বই কেনার টাকা দিতে পারেননি তাকে। অভিমানে ছেলেটি তাই আত্মহত্যা করেন। তার মৃত্যুতেও কোনো নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সৈয়দকে সমবেদনা জানাতে আসেননি। শেরপুরের মানুষ তাকে ‘মাইকের প্রচারক’ ও অত্যন্ত নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগার হিসেবেই চেনেন। দলের প্রচারের বাইরে বাণিজ্যিক পণ্যের প্রচারণার বিনিময়ে যে আয় হতো তাই দিয়ে সংসার চালাতেন। কণ্ঠস্বর ছিল ভরাট, বঙ্গবন্ধুর মতোই গমগমে আওয়াজ। মাইকে তার গলার আওয়াজ শুনলেই মানুষ বুঝে নিত ‘এ তো মুজিবপাগল সৈয়দ এমদাদের গলা!’ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের সেই প্রতিকূল সময়েও হাতে গোনা যে কজন মানুষ মিছিল করতেন তাদের সবার আগে দেখা যেত এমদাদকে। তিনি ও তার পরিবার রাজনৈতিক নিপীড়নও সয়েছেন অনেক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সংবাদ শুনে মূর্ছা গিয়েছিলেন তিনি। এক নাগাড়ে কয়েক দিন শুধ কেঁদেছেন আর কেঁদেছেন। তিনি জানান, এ হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কত লোকের দোরে দোরেই না ধরনা দিয়েছেন, কেউ সাড়া দেয়নি। টানা ৩৩ বছর সৈয়দ এমদাদ ছিলেন শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব ‘তুই’ সম্বোধন করতেন সৈয়দকে। আজও তার মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধু কত দিন তার সঙ্গে ধানমন্ডির বাড়িতে ডিম ভাজি দিয়ে পান্তা ভাত খেয়েছেন। ডিম ভাজি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খাবার। একদিনের ঘটনা বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন সৈয়দ। বলেন, ‘আমি ৩২ নম্বরের মেঝেতে শুয়ে আছি। গভীর রাতে মুজিব ভাই বাড়ি এলেন। আমায় দেখেই ভাবীকে বললেন, সৈয়দ কি খেয়েছে? খাইনি জানতে পেরে অত রাতে দোকান থেকে ডিম আনিয়ে ভাবী আমাকে ভাত খাইয়েছেন।’ ‘আমার জামা-জুতা ছিঁড়ে গেছে দেখতে পেলেই মুজিব ভাই নতুন জামা-জুতা কিনে দিতেন।’ জাতীয় চার নেতাও সৈয়দকে বঙ্গবন্ধুর মতোই আদর করতেন, ‘তুই’ সম্বোধন করতেন। আর জননেত্রী শেখ হাসিনা? সৈয়দ এমদাদুল হক বলেন, “হাসিনা আমাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে ‘কাকু’ ডাকেন। বহুবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। এত আদুরে গলায় কথা বলতেন যেন নিজ চাচার সঙ্গেই কথা বলছেন। ১৯৮৭ সালে আমার যক্ষ্মা হয়েছিল। মরেই যেতাম। হাসিনা আমার চিকিত্সার ব্যবস্থা করেন। আমার তো পরিবারে উপার্জনের কেউ ছিল না। যত দিন আমার চিকিত্সা চলেছে পরিবারটিকে হাসিনাই দেখেছেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগের দিন হাসিনা বলেছিলেন, ‘চলুন কাকু, আমার বাসায় চলুন’।

জটিল রোগে ভুগছিলাম বলে আমি যাইনি।” সৈয়দ এমদাদুল হক আওয়ামী লীগের চার নেতার সঙ্গে নানা অভিজ্ঞার কথা বলেন। ওই চার নেতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলে জানান। চার নেতার সবাই তাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। নানা আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকার নেতারা এই নেতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। কোনো সমস্যা হলেই চলে যেতেন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অথবা চার নেতার কাছে। সৈয়দ এমদাদের স্ত্রী লুত্ফুন নেসা জানান, ভাঙা শরীর তবুও অভাবের তাড়নায় মাইকে প্রচারের জন্য এখনো বেরিয়ে পড়তে চান। গলা ঠিক থাকলেও শরীরের অবস্থা দেখে কেউ আর কাজ দেয় না। সৈয়দ বলেন, ‘আমার কাছ থেকে দলের প্রচার সম্পাদকের কাজটি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক নাতিকে নার্সিং কলেজে ভর্তির জন্য কত তদবির করলাম কাজ হয়নি। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকের পদে এক মেয়েকে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করি, কর্তাদের দক্ষিণা দিতে না পারায় চাকরিটা হলো না। না, আমার কোনো দুঃখ নেই। মুজিব ভাইয়ের মেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী এটাই আমার বিরাট পাওয়া। দোয়া করি তিনি সুস্থ থেকে আরও দীর্ঘকাল দেশের সেবা করুন।’ সৈয়দ বলেন, ‘কদিন আর দুনিয়ায় আছি! একটা সাধই শুধু বয়ে বেড়াই, হাসিনার মাথায় হাত রেখে যেন দোয়াটা করে যেতে পারি।’

সর্বশেষ খবর