শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

সাক্ষ্য দিতে এসে আদালতে কাঠগড়ায় কাঁদলেন বিউটি

নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন, অন্যতম আসামি তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন এবং এম এম রানাকে অভিযুক্ত করে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি। সেলিনা ইসলাম বিউটি সাত খুনের ঘটনায় নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে

আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জেরার মুখে আবেগাপ্লুত বিউটি আদালতের কাঠগড়ায় ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সেলিনা ইসলাম আদালতকে বলেন,    নূর হোসেনের সহায়তায় র্যাবের তিন কর্মকর্তা এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আর নূরের সহযোগীরা এ হত্যায় সহযোগিতা এবং লাশ গুমে সহায়তা করেন। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টানা তিন ঘণ্টা নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে প্রথমে সাক্ষ্য গ্রহণ এবং পরে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বিউটিকে জেরা করেন। একে একে ৩২ আসামির আইনজীবী বিউটিকে জেরা করলেও সময় প্রার্থনা করেন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন, অন্যতম আসামি র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ এবং সাবেক উপ-অধিনায়ক এম এম রানার আইনজীবীরা। এ তিন আসামির পক্ষে সময় মঞ্জুর করে বিচারক বাদীকে জেরার জন্য আগামী ১০ মার্চ তারিখ ধার্য করেন। বিউটিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা যখন জেরা করছিলেন, ওই সময় বিউটির বিপরীত দিকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিলেন আসামি নূর হোসেন, তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন এবং এম এম রানা। এদিন এই চার আসামিকে একই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অন্তরঙ্গভাবে শলাপরামর্শ করতে দেখা গেছে। তবে আসামিপক্ষের জেরার সময় বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি কখনো কখনো আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেও ছিলেন শান্ত ও স্বাভাবিক। গতকাল সকালে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আসামি নূর হোসেনসহ ২৩ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। আগের তারিখের মতো গতকালও সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবি রাখতে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসামিপক্ষের করা আবেদন খারিজ করে দেন বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন। এদিন মামলার অন্যতম আসামি তারেক সাঈদ মোহাম্মদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুলতান উজ জামান বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এ মামলার অভিযোগ (চার্জ) গঠনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে পিটিশন করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের ৩৪২ কার্যতালিকায় রয়েছে পিটিশনটি। যে কোনো সময় পিটিশনটির শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। সে পর্যন্ত মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবি রাখার আবেদন করা হয় আদালতে। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে এ-সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র আদালত না পাওয়ায় বিচারক আবেদনটি খারিজ করে দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণের নির্দেশ দেন। সকাল সাড়ে ১০টায় সেলিনা ইসলাম বিউটি সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়ান। শপথ করার পর বিচারকের নির্দেশে তিনি তার সাক্ষ্য প্রদান শুরু করেন।

সাক্ষ্য প্রদান : আদালতে সাক্ষ্য প্রদানকালে সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, ‘আমার স্বামী নজরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র এবং ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। সিটি করপোরেশন ২ নম্বর ওয়ার্ডে মিজমিজি গ্রামের মোবারকের ছেলে আলী হোসেন আমার স্বামী ও ১৫ জনের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মিথ্যা মামলা করে। ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে আমার স্বামী ও তার কেস পার্টনাররা ওই মামলায় নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজিরা দেন। হাজিরা শেষে বেলা ১টা ৩৫ মিনিটে আমার স্বামী ও তার কেস পার্টনার তাজুল ইসলাম, লিটন ও স্বপন গাড়িতে চড়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। গাড়ির চালক ছিলেন জাহাঙ্গীর। ওই দিন দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে আমি আমার স্বামীর মোবাইলে ফোন দিলে তা বন্ধ পাই। পরে তার সঙ্গে থাকা কেস পার্টনারদের মোবাইলে ফোন দিলে সেগুলোও বন্ধ পাই। পরে জানতে পারি আমার স্বামী ও তার কেস পার্টনারদের বহনকারী গাড়িটি লিঙ্ক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে পৌঁছামাত্র দুটি হাইয়েস মাইক্রোবাসে করে আসা ১৫-২০ জন দুষ্কৃতকারী র্যাব পরিচয়ে তাদের অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায়।

এর আগে আমার স্বামীর সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয় ওই দিন দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে। আমার স্বামীসহ তার কেস পার্টনারদের মোবাইল ফোন বন্ধ পেয়ে আমি ঘটনাটি তাত্ক্ষণিক আমার দেবর আবদুস সালামসহ অন্য স্বজনদের জানাই। তাদের খোঁজার জন্য বাড়ি থেকে নিজেদের মাইক্রোবাস নিয়ে বের হই। তাদের না পেয়ে পুলিশ সুপার এবং র্যাব-১১কে অবহিত করি। পরদিন ২৮ এপ্রিল রাতে ফতুল্লা মডেল থানায় নূর হোসেন, ইয়াছিন মিয়া, আমিনুল ইসলাম রাজু, আনোয়ার হোসেন, ইকবাল হোসেন, শাহজালাল বাদল ও হাসমত আলী হাসুসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করি। পরে ৩০ এপ্রিল বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে জানতে পারি, শীতলক্ষ্যা নদীর শেষ মোহনায় বন্দর থানার শান্তির চরে আমার স্বামীসহ সাতজনের লাশ ভেসে উঠেছে। আমি ও স্বজনরা সেখানে গিয়ে আমার স্বামীর চেহারা ও পোশাক দেখে তাকে শনাক্ত করি। একই সঙ্গে তার কেস পার্টনারদেরও শনাক্ত করি। ৩০ তারিখে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে জানাজার পর তাদের লাশ দাফন করি। তখন আমরা জানতে পারি, নূর হোসেনের সহযোগিতায় র্যাব সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পরে কোনো আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় এ ব্যাপারে একটি রিট হলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে জড়িত র্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়।’

গতকাল সাক্ষ্য গ্রহণের সময় সাংবাদিকদের বসার জন্য আদালত কক্ষে সোফার ব্যবস্থা রাখা হয়। মামলার পিপি ওয়াজেদ আলী খোকেন জানান, বাদী বিউটিকে ৩২ জন আসামির পক্ষে আইনজীবীরা জেরা করেন। তবে অন্যতম আসামি তারেক সাঈদ, মেজর এম এম রানা ও নূর হোসেনের আইনজীবীরা সময় প্রার্থনা করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। একই সঙ্গে ১০ মার্চ এই তিন আসামির আইনজীবীদের জেরা করার তারিখ নির্ধারণ করেন।

সর্বশেষ খবর