বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

আতঙ্কে ঘরছাড়া প্রার্থীরা

গোলাম রাব্বানী

আতঙ্কে ঘরছাড়া প্রার্থীরা

ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে জমজমাট প্রচারণা চালালেও মাঠে নামতে পারছেন না বিএনপি, স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। প্রতিপক্ষের মামলা-হামলা ও হুমকি-ধমকিতে অনেক প্রার্থীই এখন ঘরছাড়া।

বিএনপি-স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীনদের হুমকিতে তাদের কর্মী-সমর্থকরা প্রচার-প্রচারণায় নামতে পারছেন না, এমনকি নিজেরাও এলাকায় যেতে পারছেন না। খুলনার কয়রা উপজেলার সদর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এস এম শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন আমার কর্মী-সমর্থকদের ওপর সশস্ত্র হামলা করছেন। নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। একটি হামলার ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় আতঙ্কের মধ্যে মাঠে কাজ করছি।’ দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী গাজী হাফিজুর রহমানও এলাকায় ঢুকতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘নৌকার প্রার্থী বনদস্যু ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নির্বাচনী কাজে ব্যবহার করছেন। এতে গোটা ইউনিয়নে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সন্ত্রাসীদের হামলার আতঙ্কে ঠিকমতো নির্বাচনী কাজও করতে পারছি না। আইনি বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে এখানে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়।’ বটিয়াঘাটা উপজেলার বাইনতলায় আমিরপুর ইউনিয়নে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান খায়রুল ইসলাম জনি বলেন, ‘প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকজন আমার সব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছেন। হামলার ভয়ে কর্মীরা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পুনরায় হামলার ভয়ে প্রচারণাও চালাতে পারছি না।’ আরও অনেকেই অভিযোগে জানিয়েছেন, ইউপির প্রথম ধাপের নির্বাচনে চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চরমপন্থি, বনদস্যু, পেশিশক্তি ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত-সহিংস ঘটনায় অধিকাংশ চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তাই প্রার্থীদের আশঙ্কা, বর্তমানের সহিংস পরিবেশ বজায় থাকলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়বে। ইসি সূত্র জানিয়েছে, ২২ মার্চ ৭৩২ ইউনিয়ন পরিষদে প্রথম ধাপের ভোট হবে। জানা গেছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় বাধার অভিযোগের মধ্যে এ ধাপে আওয়ামী লীগের ৬২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এসব ইউপির বাইরে আরও ৫৭ ইউপিতে প্রার্থী নেই বিএনপির। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের বাদ দিয়ে এ ধাপে মোট ৬৭০    ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট হবে। এর মধ্যে একটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী না থাকায় বাকি ৬১২ ইউপিতে নৌকা ও ধানের শীষ প্রার্থীরা লড়বেন। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পার হওয়ার পর ৩ মার্চ প্রতীক নিয়ে প্রচারণায় রয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বিরা। বিভিন্ন ইউপিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬১২ ইউপিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা ও বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এসব ইউপিতে চলছে জমজমাট প্রচার-প্রচারণা। তবে বিএনপির অভিযোগ, তাদের প্রার্থীরা বাধা-মামলা-হমলার কারণে প্রচারণায় অংশ নিতে পারছেন না। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দিন দিন সহিংস হয়ে উঠছে ভোটের মাঠ। ভয়ে এলাকা ও ঘর ছাড়া হচ্ছেন প্রার্থীরা। বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি, স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেওয়ারও অভিযোগ উঠছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরেও এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।

সিরাজগঞ্জ : প্রথম ধাপে রায়গঞ্জের নয়টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মনোনীত ১৮ জন এবং জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলনের একজন ছাড়াও বৃহৎ দুটি দলের আরও ২০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে মাঠে নেমেছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জমজমাট প্রচারণা চালাছেন। তবে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীনদের বাধা ও হুমকির মুখে পড়ছেন বিএনপিসহ বিদ্রোহী প্রার্থীরা। প্রার্থীদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীনরা তাদের ভোটারদের নানা ধরনের ভয়ভীতি ও মামলা-মোকদ্দমায় নাম দিয়ে হয়রানি করার হুমকি দিচ্ছেন। অনেক ভোটারকে কেন্দ্রে যেতে আগে থেকেই বারণ করে দিচ্ছেন। ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী নাসির উদ্দিন আহমদ জানান, নির্বাচনী প্রচারণায় কেউ বাধা না দিলেও তার সমর্থিত ভোটারদের ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীরা ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। ধানগড়া ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী শামসুল ইসলাম জানান, কর্মীদের মামলায় জড়িয়ে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতারের ভয় দেখানো হচ্ছে। এমনকি ‘অ্যাকটিভ’ কর্মীদের ১০ তারিখের পর এলাকাছাড়া করা হবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরিফ-উল-আলম জানান, বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।

ঝালকাঠি : ঝালকাঠিতে ইউপি নির্বাচনে নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালাতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও বিএনপি সমথিত প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় বাধাদান ও প্রার্থীদের সমর্থকদের বাড়ি গিয়ে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সদর উপজেলার গাভা রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এ এস এম শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ প্রশাসকের ভাগ্নের লোকজন আমার সমর্থকদের মামলা দিয়ে হয়রানির ভয় দেখাচ্ছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছেন। সুষ্ঠু ভোট গ্রহণে আশঙ্কা রয়েছে।’ মগড় ইউনিয়নের বিএনপি সমর্থিত আমিনুল ইসলাম কাজী অভিযোগ করে বলেন, ‘কয়েকটি মামলা দিয়ে হয়রানি করেন শাহিন হাওলাদার। শাহিন বর্তমানে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। তার হুমকির কারণে ভোটারদের কাছে যেতে পারছি না।’

পিরোজপুর : পিরোজপুরে বিভিন্ন ইউনিয়নে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও তাদের সমর্থক দলীয় নেতা-কর্মীদের হুমকি ও চাপের কারণে নির্বিঘ্নে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারছেন না বিএনপি ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। হামলা, মামলার আতঙ্কে নির্বাচনী মাঠে নামতে অনেকটাই ভয় পাচ্ছেন এসব প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। এরই মধ্যে কয়েকটি ইউনিয়নে বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারণার সময় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মীরা হামলা চালিয়ে প্রার্থীর ভাইসহ প্রায় ৩০ জনকে আহত করার ঘটনা ঘটিয়েছেন। ভেঙে ফেলা হয়েছে প্রচারণার চারটি মোটরসাইকেল ও কয়েকটি মাইক। তবে কয়েকটি ইউনিয়নে আবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর চাপে বেকায়দায় রয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। পিরোজপুরে মাত্র একটি ইউনিয়ন বাদে সব কটিতে প্রার্থী রয়েছে বিএনপির। তবে অধিকাংশ স্থানেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রচারণা চালাতে পারছেন না এসব প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও আতঙ্কে।

যশোর : যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় নির্বাচনী মাঠে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও তাদের লোকজন। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ও তার কর্মীরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই বিএনপি প্রার্থীর কর্মীদের ওপর প্রতিপক্ষের হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবাল অভিযোগ করে বলেছেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের মারধর করা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘরে হামলা করা হচ্ছে, থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ আমাদের মামলা তো নিচ্ছেই না, উল্টো আমাদের নেতা-কর্মীদের আসামি করে মামলা দিচ্ছে। যে কারণে নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।’ তবে বিএনপির এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মনিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মনিরামপুর পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ কাজী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বিএনপির অভিযোগ সত্য নয়। ১৬টি ইউনিয়নের কোথাও এমন হামলার ঘটনা ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই।’ বরিশাল : অব্যাহত হুমকি, হামলা, মহড়া এবং মামলায় আতঙ্কে রয়েছেন বরিশাল জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিএনপি মনোনীত, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। এরই মধ্যে ২ মার্চ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে গেছেন অনেকেই। আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল হোসেন লাল্টুকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগে থেকেই চাপ সৃষ্টি করছিলেন একই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোয়েব ইমতিয়াজ লিমন। খুলনা : ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চরমপন্থি, বনদস্যু, পেশিশক্তি ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রতিক একাধিক সহিংস ঘটনায় অধিকাংশ চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীর মধ্যে আতঙ্ক ভর করেছে। তারা নির্ভয়ে ভোটকর্ম করতে না পারার কথা জানিয়েছেন। এদিকে নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ না করলে ‘জঙ্গলে (সুন্দরবনে) নিয়ে’ শায়েস্তা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের মেম্বার প্রার্থী মো. গাউসুল আজমকে। এমনকি তার বাড়িতে হরিণের চামড়া ও মাংস রেখে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।  বাগেরহাট : বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলার ৪০ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী মামলা, হামলা ও প্রাণহানির আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে বিএনপির প্রার্থী রয়েছেন ১৬ জন। এ দুই উপজেলায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকসহ ভোটের দিন কেন্দ্রে না এসে তাদের সব ভোটারকে ঘরে থাকার ও প্রার্থীদের এলাকাছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা।

অনলাইনে মনোনয়নপত্র নিতে বিধি সংশোধন হচ্ছে : ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা  দেওয়ার জন্য বিদ্যমান নির্বাচন বিধিমালায় সংশোধনী আনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনলাইনে মনোনয়নপত্র পূরণ করার পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হার্ডকপি অবশ্যই রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হচ্ছে। চলমান ইউপি নির্বাচনে কিছু এলাকায় বিএনপি প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে অনলাইন সেবা চালু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ গত ৩ মার্চ আইনশৃঙ্খলা বৈঠক শেষে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা  দেওয়ার ঘোষণা দেন।

সর্বশেষ খবর