বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিদেশিদের কর ফাঁকি বন্ধে হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার

ঢাকা-চট্টগ্রামে বসছে গোয়েন্দা সেল, গঠিত হচ্ছে টাস্কফোর্স

রুহুল আমিন রাসেল

এবার বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশিদের কর ফাঁকি ধরতে হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার। তাদের কর ফাঁকি ঠেকাতে গঠন করা হচ্ছে টাস্কফোর্স। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বসানো হচ্ছে দুটি আয়কর গোয়েন্দা সেল। এখন থেকে বাংলাদেশ ত্যাগের আগে বিমানবন্দরে বিদেশিদের আয়কর পরিশোধের সনদ দেখবে ইমিগ্রেশন পুলিশ। প্রতি মাসে বিদেশি কর্মীদের তালিকা সংগ্রহ ও হালনাগাদ করবে সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর। এর বাইরেও বিদেশি কর্মীদের ওপর কড়া নজরদারি রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সঙ্গে সার্বক্ষণিক মনিটর করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। বাংলাদেশে অবস্থানরত অনুমোদনহীন বিদেশি নাগরিক এবং নিয়োগদাতাদের ওপর প্রযোজ্য আয়কর ও জরিমানা আদায় কার্যক্রম সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্প্রতি এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয় এনবিআরে। বৈঠকে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সূত্র জানায়।

বৈঠক সূত্র জানায়, এখন থেকে কোনো বিদেশি কর্মী দেশ ত্যাগের সময় বিমানবন্দরে আয়কর সনদ দেখাতে ব্যর্থ হলে তাকে আইন অনুযায়ী সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। বছর শেষে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে দীর্ঘ মেয়াদে কর্মরত বিদেশিদের কাজের অনুমতি নবায়ন করা হবে না। আবার কারও স্বল্প মেয়াদে কাজ করতে হলে তাকেও অনুমোদন নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।

বিদেশি নাগরিকদের বেপারোয়া কর ফাঁকি প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যারা বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগ দেন, তারা এবং যেসব বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে কর্মরত, তাদেরও যথেষ্ট দায়িত্ব পালনের সুযোগ আছে। বিদেশি নাগরিকরা যাতে কর ফাঁকি দিতে না পারেন সে জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের কর ফাঁকিতে জরিমানার পরিমাণও বেশি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে কর্মরত এমন দুই লাখের অধিক বিদেশি কর ফাঁকি দিচ্ছেন। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী, দেশে এখন প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার বিদেশি নাগরিক আছেন। তাদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ের দায়িত্ব সরকারের রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান এনবিআরের। প্রতিষ্ঠানটির সূত্র জানায়, দেশে প্রায় ১০ হাজার বিদেশি নাগরিক সরকারি কোষাগারে আয়কর জমা দেন। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা নেওয়া হয় রাজধানীর সেগুনবাগিচার এনবিআরের কর অঞ্চল-১১ কার্যালয়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিনিয়োগ বোর্ডের একজন উপ-পরিচালক বলেন, প্রায় ১২ হাজারের মতো বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে ওয়ার্ক পারমিট (চাকরি বা কাজের অনুমতিপত্র) নিয়ে কাজ করছেন। তবে কত সংখ্যক বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করে কাজ করছেন, সে তথ্য বিনিয়োগ বোর্ডে নেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির পাহাড়সম অভিযোগ জমেছে এনবিআরে। তবে সে অভিযোগ খুব একটা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। ফলে হাজার হাজার বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছেন। আর সহজেই এনবিআরের ভুয়া আয়কর সনদ দেখিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করছেন বিদেশিরা। এই অনিয়মের সঙ্গে বিদেশি নাগরিকদের চাকরিতে নিয়োগদাতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি জড়িত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগদাতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে মিথ্যা ঘোষণা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো বিদেশি নাগরিককে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলারের নিয়োগ দিয়ে বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে নিয়োগদাতা বলছেন, তার বিদেশি কর্মীকে মাত্র ১ হাজার ৫০০ ডলারে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি তিন হাজার ৫০০ ডলার মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করা হচ্ছে। সরকারের প্রাপ্য আয়কর ফাঁকি দিতেই এমন মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন বিদেশিরা। আর এভাবেই বাংলাদেশে বৈধভাবে কর্মরত বিদেশিরা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। তবে অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা তাদের পুরো আয়ের ওপরই রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করার সময় বিদেশিরা ভুয়া সনদ প্রদর্শন করেই পার পাচ্ছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন কর প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ অনুযায়ী, কোনো বিদেশি নাগরিক যদি বাংলাদেশে বছরে ৯০ বা তার বেশি দিন অবস্থান করেন, তাহলে তাকে একটি আয়কর ফাইল খুলতে হবে। অর্থাৎ নিয়ম অনুযায়ী ওই বিদেশি নাগরিককে আয়কর দিতে হবে। আবার তিনি যখন বাংলাদেশ ত্যাগ করবেন, তখন তাকে এনবিআর থেকে একটি ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে ইমিগ্রেশনে দেখাতে হবে। তথ্যমতে, বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে বৈধভাবে চাকরি করছেন মাত্র ১২ হাজার বিদেশি নাগরিক। পাশাপাশি বিভিন্ন রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেডগুলো থেকে অনুমতি নিয়ে আরও কয়েক হাজার বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশ চাকরি করছেন। এ অবস্থায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা দেছে, বৈধ ও অবৈধভাবে বাংলাদেশে কর্মরত হাজার হাজার বিদেশি নাগরিক ফাঁকি দিচ্ছেন সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব। তারা তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পাচার করছেন। বিদেশি নাগরিকদের এই অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দেশের অনেক অসাধু কোম্পানি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, বিদেশিরা পর্যটন ভিসায় বাংলাদেশে এসে কখনো নিজের পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে, আবার কখনো ভিসার মেয়াদ থাকা অবস্থায়ই নানা অপতত্পরতা চালান। পাসপোর্ট না থাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আটকের পর তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তৈরি হয় জটিলতা। এ সুযোগে বারবার তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।

জানা গেছে, বিদেশি নাগরিকরা অবৈধভাবে অবস্থান করে শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করছেন না, বরং অস্ত্র, সোনা ও মাদক চোরাচালান, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, বিভিন্ন দেশের জাল নোট তৈরি, ডলার জালিয়াতি, এমনকি জঙ্গি তত্পরতায়ও নিজেদের জড়াচ্ছেন। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, তাইওয়ান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, চীন, তানজানিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর