বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মংলা বন্দরে শুল্ক ফাঁকি বাড়ছে

জড়িত বন্দর কাস্টমস কর্মকর্তা ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

ইমেজ সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো মংলা বন্দরে শুল্ক ফাঁকি, ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি, জাল কাগজ তৈরি করে পণ্য খালাস, কনটেইনার থেকে পণ্য চুরির ঘটনা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার। মংলা কাস্টম হাউস কমিশনার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে দাবি করেছেন, কাজের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

মংলা কাস্টম হাউস সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ জানুয়ারি ঢাকার জিগাতলার একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খান ইন্টারন্যাশনাল ৪০ ফুটের ৫টি কনটেইনারবোঝাই বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে। ওই পণ্য প্রাথমিক পরীক্ষা করে ঘোষণার বাইরে চারটি কনটেইনারে প্রায় দুই মেট্রিক টন অতিরিক্ত পণ্যের সন্ধান মেলে। এই আমদানিকারকের নিযুক্ত মেসার্স বিএনবি শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং লিমিটেড নামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট শুল্ক বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করে দ্রুত শুল্কায়ন করে ১৬ লাখ ২১ হাজার ৭৪৮ দশমিক ৬৮ টাকা কর নির্ধারণ করা হয়। এই শুল্কায়নে সহকারী কমিশনার (জেটি পরীক্ষণ) রাজস্ব কর্মকর্তা যৌথ তত্ত্বাবধানে এই কায়িক পরীক্ষা করে কম শুল্কায়ন করেন। কনটেইনারগুলো বন্দর থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দল চালানটি আটক করে গত ২৭ জানুয়ারি। পরে আবার পুনঃ পরীক্ষায়ন করে নতুন করে শুল্ক ধার্য করে হয় ২৩ লাখ ২১ হাজার ৭৪৮ দশমিক ৬৮ টাকা। শুল্ক ফাঁকি, ওজনের তারতম্য নানা অনিয়ম চিহ্নিত হলে আমদানিকারককে জরিমানা করা হয়। একইভাবে ঢাকার বিসমিল্লাহ ইন্টারন্যাশনালের পাঁচ কনটেইনার বিভিন্ন পণ্য একই সিএন্ডএফ এজেন্ট ছাড় করে নেওয়ার মুহূর্তে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আটক করে পুনঃ কায়িক পরীক্ষা চালায়। এখানেও অসাধু শুল্ক কর্মকর্তা আর সিএন্ডএফ এজেন্ট মিলে ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৬৩ দশমিক ১৮ টাকা রাজস্ব ক্ষতি চিহ্নিত করা হয়। খুলনার একটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গত বছর ঘোষণার অতিরিক্ত ৩১ হাজার টন পণ্য আমদানি করে। পরে তারা জরিমানাসহ ৪ কোটি টাকা বেশি কর দিয়ে পণ্য খালাস করে। সূত্র আরও জানায়, ঢাকার রিও ট্রেড হাউস, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে দুই ইউনিট গাড়ি আমদানির জন্য এলসি খোলে। এই গাড়ি মংলা বন্দরে আসার পর তা খালাসের জন্য সিএন্ডএফ এজেন্ট লায়লা ট্রেডিং কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই গাড়ির বিপরীতে ২৯ লাখ ৭৪ হাজার ১৭৩ দশমিক ৮০ টাকা ট্যাক্স ধার্য করা হয়। পরবর্তীতে এই টাকা ব্যাংকে জমার জাল রসিদ তৈরি করে সিএন্ডএফ এজেন্ট গাড়ি বন্দর থেকে খালাস করে নিয়ে যায়। গত বছর ২৮ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি ধরা পড়ে। সিএন্ডএফ এজেন্ট লায়লা ট্রেডিং কোম্পানি প্রথমে বিষয়টি আমদানিকারকের দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যান। পরে গেট পাসে সিএন্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধির স্বাক্ষর শনাক্তের পর ফাঁকি দেওয়া কর পুনরায় জমা দেওয়ার অঙ্গীকার করে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও আজও ওই রাজস্ব আদায় হয়নি। একই সময় একই আমদানিকারক ও একই সিএন্ডএফ এজেন্ট ৩টি গাড়ি আমদানি করে মোট ৩৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯৩৭ টাকা জমার জাল রসিদ তৈরি করে বন্দর থেকে গাড়ি ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে সিএন্ডএফ এজেন্ট আমদানিকারকের ভুল স্বীকার করে রাজস্ব জমা দেওয়ার অঙ্গীকার করে। এ ব্যাপারে সিএন্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মংলা কাস্টম হাউস দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দেয়। ইতিপূর্বে একটি বিএমডাব্লিউ গাড়ি মংলা বন্দরে আমদানি করে রাজস্ব জমার জাল রসিদ করে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ফাঁকি দিয়ে গাড়ি নিয়ে যায়। পরে ঢাকার বিআরটিএতে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করার জন্য কাগজপত্র জমা দেয়। ঢাকা বিআরটিএ যেহেতু ২ কোটি টাকার ওপর রাজস্ব আদায় হয়েছে, তাই যাচাই করতে মংলা কাস্টম হাউসকে চিঠি পাঠালে তখনই শনাক্ত করা হয় ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার কাগজপত্র জাল। বিআরটিএর সূত্র ধরে মংলা কাস্টম হাউস এই জালিয়াতির ঘটনায় ঢাকার কাফরুল থানায় এজাহার করে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সেই মামলার কোনো আসামি ধরা পড়েনি, আদায় করা যায়নি এই রাজস্ব। মংলা কাস্টস হাউসের কমিশনার ড. মোহা. আল আমিন প্রামাণিক উল্লিখিত রাজস্ব ফাঁকি এবং ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, কায়িক পরীক্ষার টিমের তিন সদস্যকে শোকজ নোটিস দেওয়া হয়েছে। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. পারভেজ রেজা, মুনসুর রহমানসহ তিনজনের কর্তব্যে অবহেলা এবং রাজস্ব ফাঁকির সহায়তার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এই কাস্টমস কমিশনার দাবি করেন, মংলা কাস্টম হাউস চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই হাজার ৬৫৫ কোটি টাকার রাজস্ব  আদায় হয়েছে। সব কাজের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি আগের চেয়ে কমেছে বিধায় তাদের রাজস্ব আদায় ৩৮% বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ একই সময় আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬%। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য ছাড়ানোর পর আমদানিকারকের কাছ থেকে এ বছর মোট ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। যা মংলা কাস্টম হাউসের রেকর্ড। তিনি জানান, অভিযুক্ত রাজস্ব ফাঁকির ঘটনায় জড়িত সিএন্ডএফ এজেন্টকে কালো তালিকাভুক্ত বা লাইসেন্স বাতিল করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর