শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

পার্কিং না রেখেই ভবন নির্মাণ

ঢাকায় নির্মাণে আইন মানে না কেউই নিয়ম ভেঙে হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

সাঈদুর রহমান রিমন

পার্কিং না রেখেই ভবন নির্মাণ

রাজধানীর অনেক রাস্তায় এভাবেই রাখা হয় গাড়ি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

পার্কিং ব্যবস্থাহীন ভবন, মার্কেট, শপিং মল এখন যানজটসহ জনদুর্ভোগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিল্ডিং কোড অমান্য করে প্রকাশ্যে একের পর এক ভবন গড়ে উঠছে নগরজুড়ে। রাজউক, সিটি করপোরেশন কেউ বাধা দিচ্ছে না এতে। সুউচ্চ ভবনগুলোর আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের পুরোটা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য সংরক্ষিত থাকার কথা। অথচ ওই ফ্লোরের বেশির ভাগ স্থান ব্যবহূত হচ্ছে ‘গুদামঘর’ হিসেবে। গাড়ি পার্ক করার নির্ধারিত জায়গা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে বাইরের দোকানপাটের মালামাল রাখার জন্য।

গাড়ি রাখার ফাঁকা জায়গা (পার্কিং স্পেস) না রাখলে ভবনবেষ্টিত এলাকা কতটা দুর্ভোগের সৃষ্টি করতে পারে, এর জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত রাজধানীর মতিঝিল-দিলকুশা। দুঃসহ যানজটে অবরুদ্ধ মতিঝিল। শত শত গাড়ির এলোপাতাড়ি পার্কিং। রাস্তা, গলির ৫০ ভাগ বেদখল। চলছে পার্কিংয়ের যথেচ্ছ অপব্যবহার। রিকশাগুলোর তাণ্ডব তো আছেই। দিন নয় মাস নয়, বছরের পর বছর ধরে অভিন্ন অবস্থা বিরাজ করলেও রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলকে বিশৃঙ্খলামুক্ত করা যাচ্ছে না। ক্রমেই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পুরো মতিঝিল এলাকা সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, দু-চারটি বাদে আর কোনো অফিস বা প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব পার্কিং জোন নেই। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের নিচে পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা রাখতে হবে। গ্রাউন্ড ফ্লোর বা আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর কেবল গাড়ি রাখার জন্যই। হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণের অনুমতি দেয় রাজউক। তাদের অনুমোদিত প্ল্যান নিয়েই বিল্ডিং নির্মিত হয়। অথচ থাকে না কেবল পার্কিং প্লেস। মোটা অঙ্কের উেকাচ পেয়ে নীরব হয়ে যান তদারককারী কর্মকর্তারা। সব কিছু দেখেও তারা না দেখার ভান করেন। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শত শত গাড়ি নির্ধারিত পার্কিং জোনের অভাবে রাখা হয় মূল সড়কজুড়ে। মতিঝিল, দিলকুশা, বিসিআইসি রোড, বিমান অফিস চত্বর, শাপলা চত্বরের চারপাশ, মধুমিতা সিনেমা হল রোড, জীবন বীমার চারদিক, বঙ্গভবনসংলগ্ন উত্তর পাশের রাস্তায় চার-পাঁচ সারি করে গাড়ি পার্ক করা হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সেগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। প্রাইভেট সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি রাখা হয় এমনকি রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত। কারওয়ান বাজার এলাকায় বড় আয়তনের অফিস ভবন তিতাস, বিএসইসি, ওয়াসা, বিটিএমসি, পল্লী ভবন কোথাও নেই কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। দু-একটি ভবনে যৎসামান্য পার্কিং স্পেস রাখা আছে। সেগুলো শুধুই পদস্থ কর্মকর্তাদের গাড়ি রাখার জন্য সংরক্ষিত। অন্য কর্মকর্তা ও দর্শনার্থীর গাড়ি পার্ক করা হয় প্রধান রাস্তার ওপর। মিরপুর ১ নম্বর, কাজীপাড়া, মিরপুর রোডের ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, গাউছিয়া, নিউমার্কেট কোথাও নেই বৈধ পার্কিং ব্যবস্থা। রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলো এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায়। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ভাড়া নিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেদার চালিয়ে যাচ্ছে ব্যবসা। বাসাবাড়িতে গড়ে উঠেছে দোকানপাট, ব্যাংক, ডিপার্টমেন্ট স্টোর, ফাস্টফুডের দোকান। এমনকি বাড়ির গ্যারেজও পরিণত হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। কিন্তু নির্বিকার কর্তৃপক্ষ। সে সুযোগে বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে বাড়িওয়ালারাও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিচ্ছেন বাসাবাড়ি। অথচ ঢাকা সিটি করপোরেশন ও রাজউকের বিধান অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার বাড়ি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রশাসনের নাকের ডগায়ই মহল্লায় মহল্লায় বাসাবাড়িগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর চলছে অনেকটা নির্বিঘ্নে। উত্তরা মডেল টাউনের বিভিন্ন সেক্টরে প্রায় দেড় শতাধিক বাসাবাড়িতে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ৪ নম্বর সেক্টরে প্রায় ৫০টি বাড়িতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে নানারকম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ৩ নম্বর সেক্টর এক কথায় এখন পরিণত হয়েছে মার্কেটে। এ এলাকার বাসাবাড়ি ভাড়া করে তৈরি হচ্ছে ডিপার্টমেন্ট স্টোর, কমিউনিটি সেন্টার, রেডিমেট গার্মেন্টের দোকান, কনফেকশনারি। এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসও রয়েছে এ ধরনের আবাসিক এলাকায়। ৩, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের প্রায় প্রতিটি সড়কের বাসাবাড়িতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে দোকানপাট। অথচ এর কোথাও নেই পার্কিং স্পেস। এসব বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর বহু এলাকাতেই প্ল্যান পাস হয়েছে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে।

অবরুদ্ধ গুলশান, বনানী : গুলশান, বনানী, বারিধারার বেশির ভাগ এলাকা এভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে, স্থবির হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। দিনের শুরুতে এ অভিজাত এলাকায় শুরু হওয়া যানজটের ধকলই ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে। সূত্রপাত ঘটে সবচেয়ে বড় নাগরিক যন্ত্রণার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও লিয়াজোঁ কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে গুলশান, বনানী, বারিধারাতেই। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের দূতাবাসও রয়েছে। আছে নামিদামি শিক্ষা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কল কারখানার প্রধান কার্যালয়ও। ফলে হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী, গ্রাহকসহ সব শ্রেণির মানুষের নিয়মিত যাতায়াত গুলশান, বনানীতে। তারা নিয়ে আসেন প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পাজেরোসহ হরেক রকমের গাড়ি। এতসব গাড়ি বহনকৃত যাত্রীদের আবার ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আশপাশেই দিনভর পার্কিং করে রাখা হয়। ফলে পাঁচ সহস াধিক গাড়ির ভিড়ে সমগ্র গুলশান, বনানী সারা দিনই স্থবির থাকে।

গুলশান, বনানী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দু-চারটি বাদে আর কোনো অফিস প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব পার্কিং জোন নেই। ব্যস্ততম রাস্তাগুলোর দুই পাশে দু-তিন সারিতে গাড়িগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার্কিং করে রাখা হয়। পার্কিংয়ের বাইরে থাকা অবশিষ্ট কয়েক ফুট সড়ক দিয়ে গাড়িগুলোকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করতে হয়। ফলে ধীরগতির কারণেই বেঁধে যায় দীর্ঘ জট। ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা কয়েকটি গাড়ির স্টিকার দেখিয়ে বলেন, এসব গাড়ির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সাধ্য আমার নেই। স্টিকারগুলোয় ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কাজে ব্যবহূত’, ‘আইনি সহায়তা কেন্দ্র’, ‘সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী’, ‘পুলিশ’, ‘মন্ত্রণালয়ের কাজে নিয়োজিত’, ‘সরকারি ডাক্তার’ এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়নকারী একাধিক সংগঠনের নাম লেখা।

ঢিমেতালের অভিযানে রাজউক : পার্কিং স্পেসবিহীন ভবন, পার্কিং প্লেসকে দোকানপাট বা গুদাম হিসেবে ব্যবহার, ব্যস্ততম সড়ক ও ফুটপাথের সঙ্গে লাগিয়ে ভবনের অংশ বানিয়ে ফেলাসহ বিল্ডিং কোড অমান্যকারী সাড়ে তিন হাজার ভবনের তালিকা করেও ঢিমেতালে অভিযান চালাচ্ছে রাজউক। অভিযানের জন্য গঠিত তিনটি বিশেষ টিম ধানমন্ডি, গুলশান ও উত্তরায় দেড় শতাধিক ভবনে অভিযান চালাতে পেরেছে। কিন্তু নানা তদবির, চাপাচাপি, রাজনৈতিক প্রভাবের মুখে সিংহভাগ ভবন এখনো অভিযানের বাইরে রয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর