বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

নির্বাচনী এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি, শঙ্কা কাটছে না

গোলাম রাব্বানী

নির্বাচনী এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি, শঙ্কা কাটছে না

দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। আজ রাত পোহালে আগামীকাল ভোট গ্রহণ। এর আগে ২২ মার্চ প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণের মধ্য দিয়ে তৃণমূলের ভোট শুরু হয়। গতকাল এ ধাপের নির্বাচনের শেষ মুহূর্তের প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করেছেন প্রার্থীরা। কাল সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে দেশের ৬৪৬ ইউপিতে। এ নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা-অজানা শঙ্কা রয়েছে ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনায় দ্বিতীয় ধাপের ভোট নিয়ে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায়। ভোট নিয়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে সব কটি ইউপিতেই। ভোট কেন্দ্রে যেতে ভয় পাচ্ছেন সাধারণ ভোটাররা। এ ছাড়া সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রার্থীরাও। যদিও ইসি ভোটারদের      অভয় দিয়ে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ইসি বলছে, নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে চার স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকবে নির্বাচনী এলাকায়। এদিকে গতকালও ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় তিন ইউপিতে এক দিন আগেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা। ইসি কর্মকর্তারা জানান, দ্বিতীয় ধাপেও আওয়ামী লীগের ৩১ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ধাপে ৬৪৬ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে মোট প্রার্থী রয়েছেন ২ হাজার ৬৮৪ জন। দ্বিতীয় ধাপের ৬৪৩ ইউপির সঙ্গে ভোলার লালমোহন উপজেলার ৩ ইউপি যোগ হয়েছে। এ নির্বাচনে ১৭টি রাজনৈতিক দলের ১ হাজার ৫০৭ ও স্বতন্ত্র ১ হাজার ১৭৭ জন প্রার্থী রয়েছেন। এ নির্বাচনে ভোটার ৯৪ লাখ ৭৮ হাজার ৮১ জন। চেয়ারম্যান, সাধারণ ও সংরক্ষিত সদস্য— এ তিনটি পদের বিপরীতে ভোটার সংখ্যার তিন গুণ ব্যালট ছাপিয়েছে ইসি। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে গতকাল র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনী এলাকায় টহল শুরু করেছেন। তারা থাকবেন ভোটের পরের দিন পর্যন্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে রয়েছেন নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। দ্বিতীয় ধাপের ভোট গ্রহণের জন্য আজ বিশেষ নিরাপত্তায় জেলা থেকে প্রতিটি কেন্দ্রে ব্যালট বক্স, ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী মালামাল পাঠানো হবে। এ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা শেষ হয়েছে গতকাল দিবাগত রাত ১২টায়। তাই এদিন ভোর থেকেই গ্রাম-পাড়া-মহল্লায় ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটেছেন চেয়ারম্যান, সাধারণ ও সংরক্ষিত সদস্য প্রার্থীরা। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে এবারই প্রথম চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে।

ইসির কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘ভোট সামনে রেখে সব ধরনের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডিসি-এসপি-রিটার্নিং অফিসারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পরও অভিযোগ আসছে, তবে সত্যতা খতিয়ে দেখে ও তদন্ত করে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে কমিশন। আমরা সব প্রস্তুতি নিয়েছি।’

প্রচার-প্রচারণা শেষ : ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখা জানিয়েছে, গতকাল মধ্যরাতে বন্ধ হয়েছে নির্বাচনী প্রচার। ভোট শুরুর ৩২ ঘণ্টা আগে সব ধরনের প্রচার, সভা-সমাবেশ ও শোডাউন নিষিদ্ধ। ভোটের পরে ৪৮ ঘণ্টাও কোনো মিছিল করা যাবে না। প্রচারের সময় শেষ হওয়ার আগে বহিরাগতদের ছাড়তে হবে নির্বাচনী এলাকা। দ্বিতীয় ধাপের প্রচার-প্রচারণায় প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েকশ লোক আহত হয়েছেন। কাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট চলবে। ভোট উপলক্ষে এদিন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় থাকছে সাধারণ ছুটি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে : গোলযোগ-সহিংসতার মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় এ নির্বাচনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গতকাল মাঠে নেমেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনাসংক্রান্ত পরিপত্র জারি করা হয়েছে। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ২০ জন করে নিরাপত্তা সদস্য নিয়োজিত রাখা হচ্ছে এবার। ভোটের আগের দুই দিন থেকে ভোটের পরদিন পর্যন্ত চারদিন থাকবেন তারা। পরিস্থিতি বিবেচনায় কেন্দ্রভিত্তিক নিরাপত্তা সদস্য বাড়াবে স্থানীয় প্রশাসন। দলভিত্তিক এ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমালোচনার মুখে রয়েছে ইসি। সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনা খতিয়ে দেখতে শুধু গণমাধ্যমের প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে পাঠিয়ে কাজ সেরেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি। অবশ্য ভোটের পরিবেশ নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে ইসি। এ ক্ষেত্রে প্রতি উপজেলায় তিনজন নির্বাহী হাকিম ও একজন বিচারিক হাকিম থাকবেন। এ বিষয়ে ইসির উপসচিব সামসুল আলম বলেন, ইউপি ভোটের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় উপজেলাভিত্তিক মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে তিন প্লাটুন করে বিজিবি রাখা হয়েছে। সঙ্গে থাকবে র‌্যাবের তিনটি টিমও। উপকূলীয় এলাকায় বিজিবির পরিবর্তে কোস্টগার্ড থাকবে। প্রতি ইউনিয়নে পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসার সমন্বয়ে একটি করে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। অবশ্য ভোটের পরিবেশ নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনী সামগ্রী পৌঁছে গেছে জেলায়। আজ যাবে কেন্দ্রে কেন্দ্রে। এ ছাড়া আজ বিকালের মধ্যে কেন্দ্রে কেন্দ্রে বসবে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, এপিবিএন, আনসার ব্যাটালিয়ন ও আনসার-ভিডিপির প্রহরা; টহলে থাকবে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স।

শেষ মুহূর্তেও প্রার্থীদের শঙ্কা : ভোট কেন্দ্র দখলের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিএনপির অধিকাংশ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। প্রায় প্রতিটি ইউপিতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা এ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি অনেক প্রার্থী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। অভিযোগ, বিএনপি নেতা-কর্মীদের মারধর করা হয়েছে। ভোট কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টদের না যাওয়ার জন্য হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ছয় ধাপে ৪ হাজার ২৭৯ ইউনিয়নে নির্বাচনে ইসির পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বাকি চার ধাপের মধ্যে ২৩ এপ্রিল ৭১১, ৭ মে ৭২৮, ২৮ মে ৭১৪ ও ৪ জুন ৬৬০ ইউপিতে ভোট হওয়ার কথা।

আঙ্গুল চুষলে ব্যবস্থা : ইউনিয়ন পরিষদের ভোটে অনিয়ম ঠেকাতে সমালোচনার মুখে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের সতর্ক করেছেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। তিনি বলেছেন, ভোটকেন্দ্রে দর্শকের ভূমিকা রাখলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে অপরাধ হবে, আর  সেখানে তারা আঙ্গুল চুষবে— এ ধরনের কোনো বিষয় প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। প্রিসাইডিং অফিসারের সামনে সিল মেরে যাবে আর তখন হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবে— সেটাও আমরা সহ্য করব না। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যা করা দরকার সবটাই করতে হবে।

প্রথম ধাপের ভোটের আগে-পরে সহিংসতায় অন্তত ২২ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি অনিয়মের কয়েকশ অভিযোগ পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। আগামীকাল ৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপের ইউপি ভোট। এর আগে সবাইকে সতর্ক করলেন এই নির্বাচন কমিশনার। গতকাল কমিশন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের শাহনেওয়াজ বলেন, প্রথম ধাপে কিছু অনিয়ম পেয়েছি, ব্যবস্থাও নিয়েছি। এখন সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে বলতে চাই— দায়সারা কাজ করে দায়িত্ব এড়াতে চাইলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনিয়ম করলে চরম ব্যবস্থা নিতে পিছপা না হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। পরিস্থিতি দেখে আইনগতভাবে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন এই নির্বাচন কমিশনার। অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না। ব্যর্থতার জন্য কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অপরাধ করলে সে যেই হোক তাকে গ্রেফতার ও তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছি— এটা একটা সতর্ক বার্তা সবার জন্য।

এই নির্বাচন কমিশনার জানান, নির্বাহী হাকিম ও ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং অফিসারের সব ধরনের ক্ষমতা রয়েছে। তারা যে কোনো বিষয়ে ইসিকে সরাসরি অবহিত করতে পারবেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কাউকে সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, ২২ মার্চ প্রথম ধাপে ৭১২ ইউপিতে  ভোট হয়েছে। ৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপের ভোটের আওতায় রয়েছে প্রায় সাড়ে ছয়শ ইউপি। এবার মোট ছয় ধাপে ইউপি ভোট হচ্ছে, শেষ ধাপে ভোট হবে ৪ জুন।

সর্বশেষ খবর