রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

দূষিত পানি ব্যবহারে ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

‘নিরাপদ পানি: সমস্যা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

দূষিত পানি ব্যবহারে ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

বাংলাদেশ প্রতিদিন ও পিউর ইট আয়োজিত গোলটেবিলে বক্তারা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সব মরণব্যাধির জন্ম দেয় দূষিত পানি। ডায়রিয়া, কলেরা, ক্যান্সার, হেপাটাইটিস, টাইফয়েট, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগের মূল কারণ এই দূষিত পানি। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় সরবরাহ করা পানি সাপ্লাই লাইন দূষিত হচ্ছে। বোতল বা জারজাত পানির ৯০ ভাগই বিশুদ্ধ নয়। এমন ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন পানি বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ভয়াবহ ভূমিকম্পন ও দুর্যোগ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন অনেকে। এ ছাড়া নিরাপদ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে ‘নিরাপদ পানি রেগুলেটরি কমিশন’ গঠন এবং পানির অপচয় কমানোর প্রতি জোর দেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সবার জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা এখন অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এ জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের পরামর্শ দেন চিকিৎসক, পানি বিশেষজ্ঞ ও সমাজের বিশিষ্টজনরা। গতকাল ইডব্লিউএমজিএল’র কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও পিউর ইট আয়োজিত ‘নিরাপদ পানি : সমস্যা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম। গোলটেবিল বৈঠকের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করেছে বসুন্ধরা গ্রুপের সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল নিউজটোয়েন্টিফোর। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন নিউজটোয়েন্টিফোর-এর চিফ রিপোর্টার নাজনীন মুন্নী।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন সাবেক সচিব ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুসা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শ্যামল কান্তি ঘোষ, ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. খন্দকার আজহারুল হক, এলজিআরডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. শহীদুল হাসান, আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মনিরুল আলম, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রকল্প পরিচালক (বিশ্বব্যাংক প্রকল্প) এ কে এম ইব্রাহিম, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোস্তফা, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের— সাউথ এশিয়া ওয়াশ রেজাল প্রোগ্রামের হেড অব কান্ট্রি কো-অর্ডিনেশন ইউনিট পার্থ হেফাজ সেখ, ডিএসকের সিনিয়র প্রোজেক্ট কো-অডিনেটর মো. আবদুল হাকিম, র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম, সাইটসেভার্স’র অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের কো-অর্ডিনেটর আলিম বারী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব ওমর ফারুক, ব্যারিস্টার আহসান হাবীব প্রমুখ। গোলটেবিলে বক্তারা বলেছেন, দূষিত পানি ব্যবহার মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ডেকে আনছে। দেশে ৯৭ ভাগ মানুষ পানি সুবিধা পেলেও বিশুদ্ধ পানি পায় মাত্র ৩৭ ভাগ মানুষ। দূষিত পানির কারণে ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি দূষিত পানির কারণে কেমিক্যাল পয়জনিং হয়ে মানুষ মারাও যেতে পারে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক সময়ে গর্ভেই সন্তান নষ্ট হচ্ছে। অটিস্টিক শিশু ভূমিষ্ঠের পিছনেও দায়ী দূষিত পানি। এ ছাড়া বন্যার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে যত মানুষ মারা যায় তারচেয়ে বেশি মারা যায় বন্যা পরবর্তী বিশুদ্ধ পানির অভাবে।  মোহাম্মদ মুসা বলেছেন, ছয় মাসের মধ্যে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, বিশুদ্ধ পানি সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের কাছে প্রস্তাব দিলেও তারা সহযোগিতা দেবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শ্যামল কান্তি ঘোষ বলেন, যেখানে জীবন, সেখানেই পানি। কৃষি উত্পাদনের ক্ষেত্রেও পানির ভূমিকা অনেক বেশি। সরকারের উদ্যোগে বর্তমানে অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনসহ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সরকারের নানা উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন তিনি। কৃষিতে পানির প্রয়োজন অপরিসীম। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষি উত্পাদন বাড়ছে। এ জন্য কিছুটা ক্ষতি হচ্ছে। তবে কীটনাশক আমদানি কমিয়ে বর্তমানে জৈব কীটনাশক ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম বলেছেন, ছোটবেলা থেকে পড়ে এসেছি ‘পানির অপর নাম জীবন’। কিন্তু এখন পানিকে কতটা জীবন বলা যায়? কতটুকু নিরাপদ পানি আমরা পান করছি? নগরে যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে তা কতটুকু নিরাপদ? পানির জারে শ্যাওলা পাওয়া যাচ্ছে। এটা নিয়ে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. খন্দকার আজহারুল হক বলেছেন, পানির সমস্যা হাজার বছরের। আমরা নিজেরা এই পানিকে দূষিত করছি। ঢাকার অনেক অভিজাত এলাকায় স্যুয়ারেজ লাইন না থাকায় পানি দূষিত হচ্ছে। তিনি বলেন, পানির সঙ্গে আমি অনেক দিন থেকেই জড়িত। প্রকৌশলী মো. শহীদুল হাসান বলেছেন, নিরাপদ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে ‘নিরাপদ পানি রেগুলেটরি কমিশন’ গঠন এবং পানির অপচয় কমাতে হবে। আর বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের জন্য সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য অর্থ বরাদ্দও বাড়াতে হবে। আইসিডিডিআরবি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মনিরুল আলম বলেছেন, দূষিত পানির কারণে অটিস্টিক শিশুর জন্ম হচ্ছে। এ ছাড়া দূষিত পানির কারণে নানা ধরনের রোগব্যাধিও হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, আমারা যেভাবে পানি উত্তোলন করছি এ জন্য পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এ ছাড়া আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকার পানি লবণাক্ত হওয়ার শঙ্কার কথাও জানান তিনি। আমরা ৪৫০ নদীর পানি ব্যবহার করতে পারি। নদীতে ড্রাম দিয়ে সেই পানি ঢাকায় সরবরাহ করা যেতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে নদীর পানি বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কে এম ইব্রাহিম বলেছেন, সরকার নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সুপেয় পানি নিশ্চিত করার কাজটি করছে। সরকার গ্রামগঞ্জে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন খাস পুকুরের তালিকা তৈরি করছে। এসব পুকুরে পানি সংরক্ষণ করা হবে। এ জন্য কাজ চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য সরকার যেমন উদ্যোগ নিচ্ছে তেমনি জনগণের সচেতনতাও বাড়াতে হবে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোস্তফা বলেছেন, দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের— সাউথ এশিয়া ওয়াশ রেজাল প্রোগ্রামের হেড অব কান্ট্রি কো-অর্ডিনেশন ইউনিট পার্থ হেফাজ সেখ বলেন, পানি সরবরাহের সব দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র জনগণকে পানি দেবে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর উপরেও জোর দেন তিনি। ডিএসকের সিনিয়র প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মো. আবদুল হাকিম বলেন, বস্তি থেকে শুরু করে হাওর-বাঁওড় ও পাহাড়ি এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য আধুনিক টেকনোলজি দরকার। তিনি বলেন, ৪০ লাখ বস্তিবাসীকে বর্তমানে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম বলেছেন, বাসাবাড়িতে যেসব বোতল বা জারজাত পানি সরবরাহ করা হচ্ছে তার ৯০ ভাগই দূষিত। আমি গত এক বছরে ২৪টি পানি বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মাত্র ছয়টিকে মোটামুটি মানের পেয়েছি। বাকি ১৮টিই বন্ধ করে দিয়েছি। এরা ওয়াসার পানি সরাসরি জারে ভরে বিক্রি করছে। ওইসব পানি পান করার চেয়ে ওয়াসার পানি সরাসরি ফুটিয়ে পান করা অনেক ভালো।

সাইটসেভার্সের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের কো-অর্ডিনেটর আলিম বারী বলেছেন, দূষিত পানি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ডেকে আনছে। অনেকেই ফুটিয়ে বা ক্লোরিনেট করে পানি পান করছেন। তবে এটা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ করে বস্তি ও উপকূলীয় এলাকাগুলোর মানুষ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত। সবার জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা এখন অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব ওমর ফারুক বলেছেন, আমাদের নদী আছে। কিন্তু পানির প্রবাহ নেই। এ জন্য নদীতে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যারিস্টার আহসান হাবীব বলেছেন, নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য আদালতের বিভিন্ন নির্দেশনা সংশ্লিষ্টরা মানছে কি না তা মনিটর করতে হবে।

সর্বশেষ খবর