সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

পাহাড়ে রঙের উৎসব

রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

পাহাড়ে রঙের উৎসব

বৈসাবির রঙে রঙিন পাহাড় মেতেছে উৎসবে। বাতাসে ভেসে আসছে সুর আর নূপুরের ছন্দ। বছর ঘুরে বৈসাবি এলেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা গানের সুর আর নাচের তালে তালে মিশে যায়। প্রতিদিন বসে পাহাড়ি পল্লীগুলোতে জমজমাট আসর। তিন পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিয়ে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি এখন উৎসবের নগরী। এবার উৎসবে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি ছাড়া যোগ দিয়েছে দূর-দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকরাও। ধর্ম, বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সম্প্রীতির মিলনে পাহাড়ে বইছে আনন্দের বন্যা। উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে পাহাড়ি জনপদও। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলাধুলা ও বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মেলার মধ্যদিয়ে ৪ এপ্রিল শুরু হয়েছে বৈসাবির নানা উৎসব। আর এ আনন্দ উৎসব চলবে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। পার্বত্যাঞ্চলের ১০ ভাষাভাষী ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা বৈসাবিকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে পালন করে। কাল বৈসাবিকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাইং, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু ও অহমিয়ারা বিহু নামে পালন করবে। চাকমা রীতি অনুযায়ী ১২ এপ্রিল অর্থাৎ চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে নদীতে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনার মধ্যদিয়ে সূচনা করা হবে ফুলবিজুর উৎসব। পরদিন ১৩ এপ্রিল মূলবিজু এবং ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ ও গোজ্যেপোজ্যা দিন উদযাপিত হবে। ১৫ এপ্রিল উদযাপন করা হবে মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জলকেলি উৎসব। এদিকে ৪ এপ্রিল থেকে রাঙামাটির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা উৎসবে মেতে উঠেছে। বৈসাবির উৎসাহ-উদ্দীপনায় এখন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে পাহাড়। উৎসবমুখর পরিবেশে চলছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বিজু-সাংগ্রাইং-বৈসুক-বিহু (বৈসাবি) নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আয়োজন করা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নৃত্য-সংগীত, জুম্ম খেলাধুলা এবং শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বলীখেলা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও পণ্য প্রদর্শনী, বেইন বোনা প্রতিযোগিতা, চাকমা নাটক উৎসব। বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ি-বাঙালিসহ সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সম্প্রীতির মিলনমেলা। রাঙামাটি ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—মঙ্গলবার সকাল ৭টায় রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসানো উৎসব। পরে বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান ও বস্ত্র দান, ত্রিপুরা তরুণীদের গড়াই নৃত্যসহ আলোচনা সভা, সংবর্ধনা, পুরস্কার বিতরণ। গ্রামগুলোতে এখন উৎসবের আমেজ। ইতিমধ্যে জমজমাট হয়ে উঠেছে হাট-বাজারগুলোও। চলছে অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি। পাহাড়ি নারীরা খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠে বিভিন্ন কাঁচা সবজি তরকারির সংমিশ্রণে পাজন ছাড়াও নানা ধরনের পিঠা, পায়েস, ও বিভিন্ন ধানের খই, নাড়ু, সেমাই তৈরি করতে। অন্যদিকে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিনের উদ্যোগে বাংলা বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি : বিজু, বৈসু ও সাংগ্রাই উৎসবের আনন্দে পাহাড়ি জনপদ এখন মুখর। সবখানে চাকমারা বিজু, ত্রিপুরারা বৈসু ও মারমা সম্প্রাদায় সাংগ্রাইয়ের নানা কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। সদরের পানখাইয়াপাড়া বটমূলে সাংগ্রাই উৎসবের আয়োজন করেছে মারমা উন্নয়ন সংসদ। চাকমা বৈসাবি উদ্যাপন কমিটি মহাজনপাড়া সূর্যশিখা ক্লাব মাঠে নানা ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা শুরু করেছে। খাগড়াছড়ি ক্ষুুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে চার দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি চলছে। পাহাড়ের পাড়া গ্রাম এখন উৎসব আনন্দে মাতোয়ারা। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসন এ উৎসব পালনের কর্মসূচি নিয়েছে। ত্রিপুরা সম্প্রদায়রা চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ বরণ উৎসবকে বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই এবং চাকমারা বিঝু নামে পালন করে। তিন উৎসবের আদ্যাক্ষর নিয়েই বৈসাবি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈসাবি এখন পাহাড়ি সম্প্রদায়ের উৎসব নয়, এটি এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ পেয়েছে। বৈসাবির সময় পার্বত্য তিন জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে দেশ-বিদেশের শত শত পর্যটক ছুটে আসে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতিনীতি, কৃষ্টি ও পোশাক-পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত উৎসব দেখতে। চৈত্রের শেষ দুই দিন ও পয়লা বৈশাখ ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন বৈসু উৎসব হিসেবে পালন করে। বৈসুর অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে গরিয়া নৃত্য। গরিয়া নামক জুম দেবতার পূজা দেয় ত্রিপুরারা। তাদের বিশ্বাস গরিয়া দেবতার পূজা দিয়ে দেবতাকে সন্তুষ্ট করা গেলে পারিবারিক, পেশা ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। আর ত্রিপুরারা তাদের সাধ্যমতো বা মানস পূরণের জন্য দেবতাকে পশু-পাখি, খাবার ও টাকা পয়সা উৎসর্গ করে। বর্তমানে গরিয়া নৃত্যের সাদৃশ্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় খাগড়াছড়িতে। মারমাদের উৎসবের নাম সাংগ্রাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা ও রাখাইনরা অন্যান্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীদের মতো সাংগ্রাই উৎসব পালন করে। সাংগ্রাই উৎসবের অন্যতম হচ্ছে জলকেলি। বাংলা নববর্ষের একদিন পর ১৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসব। ঐতিহ্যবাহী কাপড় এবং বর্ণিল সাজগোজে তরুণ-তরুণীরা জলকেলি উৎসবে মেতে উঠে। চাকমা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা ১২ এপ্রিল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণিল পোশাক-পরিচ্ছদ পরে স্থানীয় ছড়ায় বা খালে জলদেবতার উদ্দেশে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা করে। এটিকে ফুল বিঝু বলা হয়। আর ফুল বিঝুর মধ্য দিয়ে চাকমাদের বিঝুর আনুষ্ঠানিকতা আরম্ভ হয়। দ্বিতীয় দিন হচ্ছে মূল বিঝু। ওইদিন নতুন জামা কাপড় পরে শিশুকিশোর, তরুণ-তরুণীরা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায়। তৃতীয় দিন বাংলা নববর্ষের দিনও চাকমারা বিঝু পালন করে। গ্রামগুলোতে চলে রাতভর পুঁতিগান ও গ্রাম্য নাটকের আসর। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী জেলাবাসীকে বৈসাবির শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বৈসাবি ও বাংলা নববর্ষ আমাদের সবার প্রাণের উৎসব।

সর্বশেষ খবর