বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা চূড়ান্ত

মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

জনগণের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সমুন্নত রেখে সম্প্রচার মাধ্যমসমূহের স্বাধীনতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে। সাত অধ্যায়ের এই নীতিমালা গতকালই তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশিত নীতিমালায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ক্ষেত্রে। নীতিমালায় আইনের মাধ্যমে একটা সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এই কমিশনই সম্প্রচারের জন্য লাইসেন্স প্রদানের সুপারিশ, লাইসেন্স ফি নির্ধারণ, গুণগতমান নিশ্চিতকরণ, সম্প্রচারের অন্যায্য বিষয় পরিহার এবং গোপনীয়তা  ক্ষুণ্ন করে এমন বিষয়াদি পরিহারের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ এবং পরিবীক্ষণ করবে। নীতিমালার তৃতীয় অধ্যায়ে সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় মানদণ্ড বজায় রাখার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে- সম্প্রচারিত তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা, পেশাগত নৈতিকতা ও নিরপেক্ষতা এবং সম্প্রচারের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। একই অধ্যায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে সংবাদ ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অনুষ্ঠানে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনোভাবেই দেশবিরোধী এবং জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে কোনো প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত দেওয়া পরিহার করতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ইতিহাস বিষয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- সম্প্রচারের ক্ষেত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতিমালা সমুন্নত রাখা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন, জাতীয় শোক দিবস, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ইত্যাদি উপলক্ষে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে হবে। ভাষা ও সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে- অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ক্ষেত্রে শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণের মান সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে এবং বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ ও বিদেশি ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ পরিহার করতে হবে। সব ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। এ ছাড়া উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড প্রচারের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নীতিমালায়। বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ক্ষেত্রে নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- বিনোদনের জন্য সুস্থ ধারার নাটক, চলচ্চিত্র, গান ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে হবে, শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্যমূলক আচরণ বা হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডকে উদ্বুদ্ধ করে এমন অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে, কোনো প্রকার অশোভন উক্তি/আচরণ করা এবং অপরাধীদের কার্যকলাপের কৌশল প্রদর্শন যা অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনে সহায়ক হতে পারে এমন দৃশ্য প্রচারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা এবং মানবিক অনুভূতিতে আঘাত করে এমন দৃশ্য যেমন হত্যাকাণ্ড, দুর্ঘটনায় নিহত ও আত্মহত্যাকারীর মৃতদেহ, মানুষ ও প্রাণী নির্যাতন এবং ধর্ষণ ও ব্যভিচার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কোনো নারী বা শিশুর স্থির বা চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা যাবে না। ক্রীড়া ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায়। নীতিমালার চতুর্থ অধ্যায়ে বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের বিষয়ে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনের ভাষা, দৃশ্য কিংবা নির্দেশনা ধর্মীয় অনুভূতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং রাজনৈতিক অনুভূতির প্রতি পীড়াদায়ক হতে পারবে না। পণ্য, পণ্যের মান এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। বিজ্ঞাপনের অডিও মানসম্মত এবং শ্রুতিমধুর হতে হবে, বিজ্ঞাপনে নোংরা ও অশ্লীল শব্দ, উক্তি, সংলাপ, জিংগেল ও গালিগালাজ ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। পরিবেশবান্ধব নয় এমন দৃশ্য বিজ্ঞাপনে প্রচার পরিহার করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের মতো তাত্পর্যপূর্ণ বিষয়গুলোর মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে এগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন চিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণকারী মডেলদের পোশাক-পরিচ্ছদ শালীনতাপূর্ণ হতে হবে।

নীতিমালায় শিশু ও নারীর অধিকারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ছয়টি বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিশুর নৈতিক, মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি করতে পারে এমন বিষয় বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। নীতিমালার বিবিধে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন প্রচারযোগ্য বিবেচিত হবে না। এগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়পত্রবিহীন বা অননুমোদিত অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান; সামাজিক ও আইনগতভাবে স্বীকৃত নয় এমন ক্লাব বা সমিতি; লাইসেন্সবিহীন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড এবং কর্মস্থান প্রতিষ্ঠান; বাজি ধরা, জুয়া খেলা বা এ সংক্রান্ত সংস্থা, কোম্পানি ও ব্যক্তি; তামাক, তামাকজাত পণ্য, মদ, অ্যালকোহল মিশ্রিত নেশাজাতীয় পণ্য (অ্যালকোহলের পরিমাণ যাই হোক না কেন), মাদক বা নেশাজাতীয় পণ্য; পুরুষ, মহিলা ও শিশু-কিশোরদের স্লিমিং, ওজন হ্রাস অথবা সীমিতকরণ ও ফিগার নিয়ন্ত্রণ এর জন্য ব্যবহূত অননুমোদিত ওষুধপথ্য ও চিকিৎসা এবং যৌন দুর্বলতা, অকাল বার্ধক্য ইত্যাদি সংক্রান্ত চিকিৎসা, স্বপ্নে প্রাপ্ত ওষুধ, মাদুলী, কবজ, জাদু ইত্যাদি এবং সরকারের অনুমোদনহীন আবাসিক এলাকা, ভবন বা স্থাপনার বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। নীতিমালার পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, জাতীয় আদর্শ বা উদ্দেশ্যের প্রতি কোনো প্রকার ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ, বাংলাদেশের জনগণের  অবমাননা অথবা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অখণ্ডতা ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন দৃশ্য প্রচার করা যাবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন ধরনের সামরিক, বেসামরিক বা সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না।

 জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার ষষ্ঠ অধ্যায়ে কমিশন গঠনের কথা উল্লেখ করে আরও বলা হয়েছে, কমিশন সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান, তথ্য এবং বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত মান সম্পর্কে জনগণের অভিযোগ গ্রহণ এবং তা নিষ্পত্তিকরণের ব্যবস্থা করবে। কমিশন হবে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। আর সর্বশেষ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সম্প্রচার নীতিমালার আলোকে প্রতিটি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট চার্টার অব ডিউটিস ও সম্পাদকীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যা কোনোভাবেই সম্প্রচার নীতিমালার পরিপন্থী হতে পারবে না এবং কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।

সর্বশেষ খবর