বৃহস্পতিবার, ৫ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

অস্তিত্ব সংকটে নাটোরের ৩২ নদ-নদী

নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর

অস্তিত্ব সংকটে নাটোরের ৩২ নদ-নদী

হারিয়ে যাচ্ছে নাটোরের ছোট-বড় প্রায় ৩২টি নদ-নদী। পানির অভাবে মিলছে না মাছ। কৃষিকাজেও বেড়েছে খরচ। এক সময় এখানে বড় নৌকা-স্টিমার চলত। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমের আগেই হারিয়ে যায় এসব নদীর প্রাণ। হারিয়ে যেতে বসেছে জেলার বড়াল, মুছা, নারোদ, নন্দকুজা, আত্রাইসহ ছোট বড় অধিকাংশ নদী। চলাচল না থাকায় পাড়েই অলস পড়ে আছে নৌকাগুলো। নাটোরের এসব নদীর আয়তন ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ হারিয়ে যাচ্ছে মিঠাপানির দেশি প্রজাতির নানা প্রকার মাছ। সময়ের বিবর্তনে চলনবিল আজ মরে যাচ্ছে। এক সময়  যে বিল পানিতে থৈথৈ করত সেখানে আজ সবুজ ফসলের সমাহার। বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের অধিকাংশ সময়ই পানিশূন্য থাকে নদীগুলো। নদীর বুক চিরে রেললাইন ও মহাসড়ক নির্মাণসহ অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ-কালভার্ট, স্লুইসগেট, বাঁধ- ক্রসবাঁধ এবং বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, দখলসহ নানা কারণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। ইতিহাস ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চলন্ত বিল থেকে চলনবিল নামের উত্পত্তি। চলনবিল মত্স্য ও শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত। হাজারো অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে শীতকালে। এর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ছিল খরস্রোতা বহু নদী-খাল। নদ-নদীগুলোর মধ্যে করতোয়া, ফুলজোড়, আত্রাই, বড়াল, গুড়, হিজলী, তুলশী, ইছামতি, নন্দকুজা, গুমানী, চৈচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, কুমারডাঙ্গা, মরা আত্রাই ও মরা করতোয়া, গাড়াদহ উল্লেখযোগ্য। নাটোর পৌর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নারদ নদ এখন প্রভাবশালীদের দখলে। এ নদের দুই পাশ দখল করে গড়ে উঠেছে বস্তি, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। অতীতের চলনবিল ছিল বিশাল। বছরের অধিকাংশ সময়ই পানিতে থৈথৈ করত চলনবিল। নৌকাই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ১৯০৯ সালের পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের জরিপ অনুযায়ী প্রাচীন চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার। খরা মৌসুমে শুকিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটারে। ১৯৪০ সালে পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে প্রচার বিভাগের তথ্যমতে, তখন এর আয়তন ছিল ৪৪১ বর্গমাইল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে চলনবিলের মধ্য দিয়ে পূর্ব  থেকে পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ হতে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত  রেললাইন নির্মাণ করা হয়। তখন থেকেই বিলের অপেক্ষাকৃত উঁচু উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে ভাটা পড়ে। এরপর থেকেই চলনবিলের আয়তন সংকীর্ণ হতে শুরু করে। পদ্মা নদীর পলি জমে গত কয়েক দশকে নদ-নদীগুলোর দক্ষিণাংশের প্রায় ২১ বর্গকিলোমিটার এলাকা শুকিয়ে গেছে।  সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণের পর পানি প্রবাহে আরও বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পলি জমে দ্রুত ভরাট হচ্ছে। জরিপে আরও দেখা গেছে, বিলে পানি সরবরাহকারী নদী দ্বারা বছরে প্রায় ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি জমা হয়। আর ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বিভিন্ন নদী ও ক্যানেল দিয়ে বের হয়ে যায়। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৪.৮ মিলিয়ন ঘনফুট পলি জমা হয় এই বিলে। এই পলি যদি ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সমভাবে বিস্তৃতি করে দেওয়া হয় তাহলে প্রতি বছর এর উচ্চতা প্রায় ১.২৭ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলনবিলকে রক্ষা করতে হলে যমুনা ও পদ্মা নদীসহ চলনবিলের প্রধান প্রধান নদী ও খাল ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে পানির প্রবাহ সৃষ্টি ও ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। জন-অংশগ্রহণের ভিত্তিতে চলনবিল অথরিটি প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্কারের অভাবে দ্রুত মানচিত্র  থেকে হারিয়ে যেতে পারে নদীগুলো। তাই জেলার কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের স্বার্থে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

সর্বশেষ খবর